আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন
বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৯   |   sonalisandwip.com
সন্দ্বীপ টাউন : মানচিত্র থেকে হারিয়ে  যাওয়া সমৃদ্ধ এক জনপদ


 :: সাইফ রাব্বী ::
    সুসজ্জিত অফিস-আদালত, পাকা সড়কের পাশে সারিবদ্ধ দোকান, শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখরিত শিক্ষাঙ্গন, দিঘীর চারিপাশে বিনোদনসমৃদ্ধ মেঠো পথ,পরিকল্পিত আবাসিক  কলোনী সবই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি সন্দ্বীপ টাউন। মেঘনার করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ টাউন এখন কেবলই স্মৃতি।


শত শত বছরের ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ এ উপজেলা শহরটি ২০০০ সালে সাগরে সম্পূর্ণরুপে বিলীন হয়ে যায়। প্রায় দু’বর্গ কি.মি. জুড়ে বিস্তৃত এ উপশহরটির অবস্থান ছিল বেশীরভাগ হরিশপুর ইঊনিয়ন জুড়ে। উত্তরে প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র চারি আনির হাট,দক্ষিনে পোলঘাট সংলগ্ন সাওতাল খালের শাখা, এবং তার পূর্বে একদিকে রহমতপুরের পোলঘাট পেরিয়ে সরকারি হাজী এ.বি কলেজ গেইট সহ ধলই পাড়া পর্যন্ত এবং অপরদিকে মূল শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় থেকে পূর্বদিকে সাবেক সিও(উন্নয়ন) অফিস পেরিয়ে মার্কেজ পর্যন্ত ছিল এর ব্যাপ্তি। এ ছাড়া পশ্চিমদিকে প্রশস্ত পাকা রাস্তা ধরে স্টিমার ঘাট পর্যন্তও এ শহরের পরিচিতি ছিল।
     উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পশ্চিমে অবস্থিত মেঘনা চ্যানেল থেকে খাল পথে এ শহরের দুরত্ব ছিল প্রায় ৪ মাইল। বিখ্যাত সাওতাল খাল টাউন সংলগ্ন থাকায় নৌপথে সন্দ্বীপে মালমাল পরিবহন ক্ষেত্রে এ খাল ছোট্ট নদী বন্দরে পরিণত হয়েছিল। খালের ওপর নির্মিত কার্গিল ব্রিজটি শহরের দু’পাড়ের মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম করে তুলেছিল। ব্রিজ তৈরীর আগে এক সময় এক পয়সার খেয়াতে এখানে পারাপার হ’ত। দেশের বিভিন্ন নৌ-বন্দর থেকে আগত নৌযানের ভিড়ে এটি ছিল সব সময় সরগরম। কার্গিল ব্রিজের পূর্বপাশ পোল ঘাট হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আড়ত ছিল এবং বড় বড় পাইকারীর দোকান ছিল। এখানকার পোলঘাট মসজিদটিও ছিল দর্শনীয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এ পোলঘাটে নির্মিত সরকারি বিদ্যুৎ ভবন থেকে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রতিদিন বিকেল ৫ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হত। হাজী এ.বি কলেজ ছিল উত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র সরকারি কলেজ। দ্বীপের একমাত্র কলেজ হওয়ায় সন্দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তি হত। কলেজের উত্তর পাশে ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাপ্তরিক ভবন,দীঘি ও বিলাসবহুল রেষ্ট হাউস।
    তৎকালীন জেলা প্রশাসক মিষ্টার কার্গিল এর উদ্যোগে সন্দ্বীপ টাউনের দক্ষিন প্রান্তে ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কার্গিল হাই স্কুল। দক্ষিনমূখী  ’ই’ টাইপের স্কুলটির মাঠ ছিল বিশাল যা বিভিন্ন প্রতিযোগীতা ও সমাবেশের জন্য ব্যবহার করা হত। এ মাঠে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় স্কুল প্রতিযোগীতা ছাড়াও জমজমাট ফুটবল টুর্ণামেন্টের আয়োজন করা হত। দেশের দু’জনপ্রিয় ফুটবল টিম আবাহনী ও মোহামেডানের শাখা ছিল এ শহরে। যেদিন দু’দলের মধ্যে টুর্ণামেন্টের খেলা চলত ঐদিন ফুটবলপ্রেমী শত শত মানুষের  ভিড় জমত এ মাঠে। গ্রাম থেকে আগত দর্শকদের অনেকে খেলা শেষে সন্দ্ব্যায় ষাটের দশকে প্রতিষ্টিত ‘সেকান্দর মহল’ সিনেমা হলে দল বেঁধে ছবি দেখে বাড়ী ফিরতেন। শহরের উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত ছিল মূল পাকা সড়ক। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শাখা সড়কও ছিল এবং সেগুলোও ছিল পাকা। সড়কের দু’পাশে সুসজ্জিত বিভিন্ন দোকান পাট, সরকারি-বেসরকারি  ব্যাংক সহ বিভিন্ন দপ্তরের স্থাপনা ছিল। দোকান পাট সমূহে ছিল হরেক রকম পন্যের সমাহার। প্রতিদিন গ্রাম থেকে মানুষ তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য শহরে আসত। অপরদিকে সকল গুরূত্বপূর্ণ দপ্তরসমূহ একইস্থানে কেন্দ্রীভূত থাকায় দৈনন্দিন শহরে সাধারন মানুষের উপস্থিতি থাকত জমজমাট।
     কার্গিল হাই স্কুলের সামান্য উত্তরে সড়কের পূর্ব পাশের্^ ছিল সন্দ্বীপ থানা ভবন। আর সড়কের পশ্চিম পাশের্^ ছিল জেলা পরিষদের দৃষ্টিনন্দন ডাকবাংলোর অবস্থান, বাংলোর কিছু উত্তরে ছিল টাউন বাজার। বাজার সংলগ্ন ছিল সাব রেজিষ্ট্রি অফিস ও টাউন মসজিদ। রেজিষ্ট্রি অফিস সংলগ্ন কুদ্দুছ হোটেলের কথা ভোজনপ্রিয় মানুষ এখনও ভোলেনি।এর পাশাপাশি আধুনিক সাজে খাবার হোটেল মোস্তফা ও আবাসিক বোর্ডিংও ছিল। মোস্তফা হোটেল পেরিয়ে একটু সামনে গেলে রাস্তার পূর্ব পাশের্^ ছিল সোনালী ব্যাংক। ঐ গলিতে ঢুকে কিছুটা পূর্বদিকে গেলে সমাজ সেবার পুকুর ও স্থাপনা ছিল এতিমদের সেবায় নিয়োজিত।
    পাঁচ রাস্তার মোড় ছিল সন্দ্বীপ টাউনের একটি অতি পরিচিত স্থান। এ মোড়েই ছিল ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। হাসপাতাল সংলগ্ন পশ্চিম পাশের্^ ছিল ডাক্তার নার্স ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবন। এক সময় এখানে গাইনী ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন হত। হাসপাতালে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরনে বাংলাদেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করা হয়েছিল এ হাসপাতালে। রাজনৈতিক দলসমূহের তাৎক্ষনিক সভা- সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রতিবাদের স্থান ছিল এটি। পাঁচ রাস্তার মোড়ের একটু উত্তর পাশের্^ ১৯২০ সালে প্রতিষ্টিত হয় সন্দ্বীপ টাউন হল ও পাবলিক লাইব্রেরী। পড়ন্ত বিকেলে জ্ঞানপিপাসু ছাত্র-যুবক ও সুধিজনদের আড্ডায় মুখরিত থাকত পাবলিক লাইব্রেরী। শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে টাউন হলে বিচিত্রা অনুষ্ঠান ও নাটকের মঞ্চায়ন হত। পাঁচ রাস্তার মোড় থেকে একটু পশ্চিমে গেলে ডান পাশেই ছিল বিখ্যাত প্রিয়লালের মিষ্টির দোকান। এর একটুূ সামনে গেলেই দেখা যেত উন্মূক্ত পরিবেশে বিনোদনের উল্লেখযোগ্য স্থান আবু তোরাব চৌধুরীর বিশাল দীঘি। টাউনদীঘি হিসেবে অধিক পরিচিত এ দীঘিটি সাধারন মানুষের ব্যবহারের সুবিধার্থে চারপাশে চারটি বড় ঘাটলা নির্মান করা হয়েছিল। এ দীঘির পূর্ব পাড়ের উত্তর কোণে ছিল প্রধান ডাকঘর, মোমেনা সেকান্দর প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়। দক্ষিন পাড়ে ছিল মুন্সেফ ও ম্যাজিষ্ট্রেটের সরকারী বাসভবন। চার রাস্তার মোড় থেকে পূর্বদিকে কয়েক মিনিট হেটে গেলে হরিশপুর বোর্ড অফিসের পাশে ছিল সি.ও( উন্ন্য়ন)অফিস। পরে এটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও উপজেলা পরিষদ কার্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ কার্যালয়ের পেছনে ছিল উপজেলা চেয়ারম্যানের দৃষ্টিনন্দন বাসভবন। এর উত্তরে ছিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসভবনসহ ইউ.এন.ও’র বাসভবন এবং তার সামনে ছিল তাদের ব্যবহারের জন্য তৈরী করা দীঘি। সত্তর দশকের শেষ দিকে সি.ও অফিসের পাশে প্রতিষ্ঠিত জনস্বাস্থ্য অফিসের তত্ত্বাবধানে ভূ-গর্ভস্থ পানি সরবরাহ লাইন তৈরী করে প্রতিদিন বিকেলে বাসা-বাড়ীতে দু’ঘন্টা সুপেয় পানি সরবরাহ করা হত। শহরের একটু উত্তর পার্শে^ ছিল লাশ ঘর, তার পাশেই ছিল টি এন্ড টি-ওয়ারল্যাস অফিস। এ  টি এন্ড টি ভবন থেকে শহরের দোকান-পাট, অফিস-আদালত, বাসা- বাড়িতে টেলিফোন সংযোগ প্রদান করা হয়েছিল। লাশঘরের কাছাকাছি ছিল হেলিপ্যাড এবং সরকারী ডাক বাংলো। সন্দ্বীপ শহরের পূর্ব প্রান্তে মার্কেজের কাছাকাছি হেলিকপ্টার সার্ভিসের মাঠ ছিল। শহর থেকে পশ্চিম দিকে স্টীমার ঘাটে যাওয়ার রাস্তা ছিল পাকা ও প্রশস্ত।
     সন্দ্বীপ শহরের উত্তর প্রান্তে চারি আনি হাটের পাশর্^ মোঘল আমলে  নির্মিত  সাহেবানী মসজিদ  দেখতে  দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আসত। শহরে হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের জন্য ৩/৪টি  মন্দির ছিল। তন্মধ্যে জগন্নাথ মন্দির ও সিদ্বেশ^রী কালি বাড়ী ছিল বিশেষ পরিচিত।
      সন্দ্বীপ টাউনের পরিকল্পিত আবাসিক কলোনীতে বসবাসকৃত বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে একধরনের আভিজাত্য বিরাজ করত। জীবন-জীবিকার তাগিদে সন্দ্বীপের অধিবাসী ছাড়াও এ শহরে বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, আইনজীবি, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক বসবাস করে গেছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব  ছাড়াও  প্রধান রাজনৈতিক দলের দু’নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এ শহরের আতিথেয়তা গ্রহন করেছেন। মেঘনা চ্যানেলে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হারামিয়া নিউ কমপ্লেক্সে এখন বেশীর ভাগ অফিস-আদালত স্থানান্তর হওয়ায় বর্তমানে এটি ধীরে ধীরে বিকল্প সন্দ্বীপ টাউন হিসেবে গড়ে উঠছে।

 :: সাইফ রাব্বী ::