আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার, ০২:৫২ অপরাহ্ন
সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৯   |   sonalisandwip.com
সদিচ্ছা আর সাধারণ কিছু পদক্ষেপ প্রতিরাধ করতে পারে ভেরিফিকেশন নামের ঘুষ বাণিজ্য, হ্রাস করতে পারে জনদুর্ভোগ এবং পুনরুদ্ধার করতে পারে পুলিশ বিভাগের হৃত সুনাম

এম. এ. হাশেম আকাশ

সময় এসেছে পরিবর্তনের। পাসপোর্ট নিতে গিয়ে কিংবা সরকারি চাকুরিতে যোগদানে পুলিশ ভেরিফিকেশন নামের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। বলতে গেলে রাষ্ট্রযন্ত্রের আন্তরিক সদিচ্ছাই এর জন্য যথেষ্ট।
পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে চলতে থাকা অবাধ ঘুষ বাণিজ্য একদিকে যেমন পুলিশ বিভাগে সুনামকে ক্ষু্ন্ন করছে তেমনি অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নৈতিক স্খলনকে উসকে দিচ্ছে। অপরদিকে পুলিশ বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরিসহ গোটা জাতিকে দুর্নীতির চক্রে আবদ্ধ করছে। মূলত পাসপোর্ট পেতে এবং সরকারি চাকুরিতে যোগদানের সময় এ ঘুষ বাণিজ্যের মুখোমুখি হতে হয় বেশিরভাগ মানুষকে।
সম্প্রতি প্রকাশিত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনমতে, নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ‘ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত টাকা’ দিতে হয়। হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। তবে সুবিধাভোগী পুলিশ বিভাগের একটি অংশ চায় না এটি বাতিল হোক। টিআইবির ওই প্রতিবেদনে নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ এবং ‘অপরাধী তথ্য ভাণ্ডার’ তৈরি করে তার সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করার সুপারিশ করা হয় যা বাস্তবসমম্মত।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে। ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজের জন্য অনিয়ম ও হয়ারনির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাদের ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষের গড় পারিমাণ ৭৯৭ টাকা। আর পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের গড় পরিমাণ দুই হাজার ২২১ টাকা। এছাড়া পাসপোর্ট অফিসের আবেদনপত্রে সত্যায়ন ও প্রত্যয়নের বিধানও বাতিল করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। প্রতিবেদনে তথ্য ও ফলাফল নিয়ে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। তবে যুগের প্রেক্ষাপটে তাদের সুপারিশগুলো বাস্তবসম্মত এবং বাস্তবায়নও সহজ বলে মনে করি।
কতটা সহজ ও কিভাবে?
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে একটুখানি আন্তরিকতা একটু সতর্কতার সাথে নিম্নের কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন করে খুব সহজেই এর সমাধান সম্ভব হতে পারে।
এজন্য তিনটি কাজ জরুরিঃ ১। দেশের বেশিরভাগ নাগরিক ইতোমধ্যে জাতীয় পরিচয় পত্র/ভোটার কার্ড পেয়েছেন। যারা এখনও পাননি সরকার গুরুত্বের সাথে নিলে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই তা সম্পন্ন করা সম্ভব।
২। দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োজন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী ও চাঞ্চল্যকর মামলার আসামীদের একটি ডাটাবেজ তৈরী। এটাও খুব কঠিন কাজ নয়। কেননা উপজেলা/থানা ভিত্তিক পুলিশি ডাটাবেজ ও ফৌজদারী আদালতগুলোর ইউনিট ভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরী করে সেগুলো সমন্বিত করে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরী করা প্রয়োজন যা বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে একটি সহজসাধ্য ও স্বল্প আয়েশের বিষয়।
৩। তৃতীয় কাজটি হচ্ছে থানা/উপজেলা ও দেশের সকল ফৌজদারী আদালতের সাথে এর লিংক তৈরী করে দিয়ে চাঞ্চল্যকর মামলা ও আদালতের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ডাটাবেজ আপডেট করা বাধ্যতামূলক করে দেয়া। একই সাথে পাসপোর্ট অফিস ও অন্যান্য সরকারি দফতরকে এ ডাটাবেজের এক্সেস দেয়া যাতে পাসপোর্টের আবেদন প্রসেস করার সময় এবং সরকারি নিয়োগের সময় সংশ্লিষ্ট দফতর উক্ত ডাটাবেজ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য ভেরিফাই করে নিতে পারে। এক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর ডাটাবেজ ও মামলার আসামীদের ডাটাবেজ থেকে সফট্‌ওয়ার/প্রোগ্রামের মাধ্যমে অনলাইন ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করে নিলেই এ কাজের ৯০ ভাগ অগ্রগতি সাধিত হবে। পাসপোর্ট করার সময় বা চাকুরীতে যোগদানের পূর্বে কর্তৃপক্ষ অনলাইনের মাধ্যমে ডাটাবেজ ভেরিফাই করবে। যেসব আবেদনকারীর ক্ষেত্রে অনলাইন ডাটাবেজে কোন নেগেটিভ তথ্য থাকবে না তাদের ভেরিফিকেশসন সয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হবে। কারো ক্ষেত্রে অনলাইন ডাটাবেজে নেগেটিভ তথ্য পাওয়া গেলে বা কারো তথ্য অনলাইনে না থাকলে বা জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকলে তাদের ক্ষেত্রে আলাদা ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ভেরিফিকেশনের নামে চলতে থাকা অবাধ ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক হলেও অজ্ঞাত কারণে তার বাস্তবায়ন হয় না। টিআইবির প্রতিবেদনের তথ্য, উপাত্ত বা ফলাফলের বিষয়ে কারো কারো দ্বিমত থাকলেও বাস্তবক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টির ক্ষিত্রে দ্বিমত পোষনের সুযোগ নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে মাত্র কিছুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব ঘটনার উদাহরণ দেয়া যাক, সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরে ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় অন্য একটি সরকারি সংস্থায় ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে চাকুরী পান মি. জনি (ছদ্ম নাম)। যথারীতি কর্মকর্তা পদে যোগদানের পূর্বে তাঁর পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন। ভদ্রলোক পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য গেলে তাঁকে অযথা ঘুরাতে থাকে। তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতরে কর্মরত (সঙ্গত কারণে দফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানার পরেও নিস্তার পাননি। দফতরের পরিচয় দেয়ার পরও কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি কিছু টাকা দিতে সম্মত হন। কিন্তু টাকার অঙ্কটা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পছন্দ না হওয়ায় বিভিন্ন উসিলায় ঘুরাতে থাকেন। পরবর্তীতে পুলিশ বিভাগে চাকুরীরত তাঁর পরিচিত এক জুনিয়র পুলিশ কর্তকর্তাকে সাথে নিয়ে টাকার অঙ্কটা কমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এদিকে চাকুরীতে যোগদানের সময় চলে যাওয়ার ভয়ে পরিশেষে দাবি করা অর্থ পরিশোধ করেই তাকে ছাড়পত্র নিতে হয়। এমন পরিস্থিতির শিকার বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পুলিশের প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের প্রতি মানুষের হারানো আস্থা ফিরানোটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্য দেশে দেখা যায়, বিপদের সময় পুলিশ পাশে এসে দাঁড়ালে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আর আমাদের দেশের মানুষ মনে করেন পুলিশ আসলোতো ঝামেলাটা আরো বাড়লো। তাই সমস্যায় পরেও অনেকে পুলিশেকে তা জানাতে চান না যেটা আমাদের দেশের অপরাধ নির্মূলের পথে একটি বড় বাধাও বটে।
কিন্তু ভেরিফিকেশন বন্ধের ক্ষেত্রে পুলিশের একটি খোঁড়া অজুহাত থাকে, ভেরিফিকেশন না থাকলে খারাপ লোকেরা পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। অথচ প্রচলিত নিয়মে শুধু ভালো লোকরাই পাসপোর্ট পাচ্ছে এমন কথাও সর্বৈব মিথ্যা। ভেরিফিকেশনের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ গিয়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি করে দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে মর্মে বারবার প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম তার বড় প্রমাণ। এক্ষেত্রেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পরিচয় পত্র ও পাসপোর্ট অর্জন রোধে সরকার একটি বড় সুযোগ নিতে পারে। কেননা জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকৃত ১১,১৮,৫৭৬ জন রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে উক্ত ডাটাবেজকে ব্যবহার করে পাসপোর্ট অধিদপ্তর তাদের পার্সপোর্ট পাওয়া থেকে সহজেই বিরত রাখতে পারে। নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয় পত্র দেয়ার ক্ষেত্রেও উক্ত ডাটাবেজ ব্যবহার করতে পারে।
সরকারি উদ্যোগের সাথে ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাধারণ কিছু পদক্ষেপই জনগণের এহেন ভোগান্তিহ্রাসের জন্য যথেষ্ট। এছাড়া এমন উদ্যোগ পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি উন্নয়নসহ আমাদের দুর্নীতিপ্রবন সমাজ ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিতে পারে।