আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ || ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার, ০১:০৫ পূর্বাহ্ন
শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২   |   sonalisandwip.com
সন্দ্বীপের ভাষায় শব্দের উচ্চারণ বিভ্রাট এবং তার প্রতিকার- প্রকৌশলী তামজিদুর রহমান



ভাষার আঞ্চলিকতার প্রভাব পৃথিবীর সব দেশে আছে। তেমনি আছে বাংলাদেশেও। প্রতি ১৫ মাইল দুরত্ব অতিক্রম করলেে ভাষার পরিবর্তন অনুভূত হয়। কিন্তু শ্রুতি মধুরতা বিঘ্নিত হলে তখন মানুষ সেটাকে অপছন্দ করে।
সন্দ্বীপের লোকদের অভ্যাস শব্দ উচ্চারনে সংক্ষেপ করে উচ্চারণ করা। শব্দ উচ্চারণ স্থান, যাকে আরবীতে বলা হয় মাখরাজ, ইংরেজীতে বলা হয় Vocal Organs. সন্দ্বীপের লোকেরা কিছু কিছু উচ্চারণ স্থানকে তথা অক্ষরকে বাদ দিয়ে সহজে উচ্চারণ করেন। যেমন ঃ এখনকে অন, তুমিকে তুঁই, আমিকে আঁই, পুকুরকে হইর আবার ফকিরকেও হইর বলে। মানুষের নাম যেমন: সিকান্দরকে সেন্তর, আরও পরিবর্তন করে সংক্ষেপে সেকু, লুৎফর রহমানকে লোতরন, লুতু ইত্যাদি সংক্ষেপে ডাকা হয়।
তারপরে আছে মানুষের নামের শেষ অক্ষর দিয়েও উচ্চারন করে, স্বাভাবিক ভাবে যেটি তুচ্ছার্থে বলার সামিল। যেমন- আলম থেকে আলাইম্মা, খালেক থেকে খালিক্কা, আব্দুল থেকে আব্দুল্লা ইত্যাদি।
সন্দ্বীপে বাড়ীর নাম রাখা হয় বাড়ীর প্রসিদ্ধ লোকের নামানুসারে। এরপরও অনেক বাড়ীর বিকৃত নাম শুনা যায়, এগুলি সাধারণত অশিক্ষিত ও টাউট শ্রেণীর লোকেরা দিয়ে থাকে। দুঃখের বিষয় হল- শিক্ষিত, ভদ্র, লোকেরাও এগুলি নিরুৎসাহিত না করে কিছুটা হেয়ালীপনা করে সেই বিকৃত নামেই ডেকে থাকে।
একবাড়ীর গরুর বাছুর মারা গেলে শুকনা খর দিয়ে বাছুরের প্রতিকৃতি বানিয়ে দুধ দোহন করার প্রচেষ্ঠা করা হয়, সে থেকে সে বাড়ীর নাম দেয়া হলো হাম্বাওয়ালার গো বাড়ী। বাড়ীর লোকদের বলা হল- হাম্বাওয়ালা। এক বাড়ীর লোক কথায় কথায় হাসে তাই ওদের বাড়ীর নাম হল হেটকাইন্নারগো বাড়ী। কতইনা শ্রুতিকটু!
একবাড়ীতে অনেক কামলা, সন্দ্বীপের ভাষায় বদিল্লা কাজ করছে, তাদেরকে হুক্কায় ধুমপানের জন্য তামাক দেয়া হয়েছে। অজানা কারনে তামাক থেকে কাঁটালের গন্ধ করছিল, ব্যাস আর যায় কোথায়, অমনি কামলারা নাম দিয়া দিল- কাঁয়ইল্লারগো বাড়ী। সন্দ্বীপের নিযমানুযায়ী উচ্চারনের সহজীকরন প্িরক্রয়ায় পরে সে বাড়ীর নাম হয়ে গেল কায়াইল্লারগো বাড়ী।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভদ্র-অভদ্র নির্বিশেষে সকলে বাড়ীর আসল নাম বাদ দিয়ে এই খুঁত নামে ডাকতে থাকে সন্দ্বীপের ভাষায় যাহাকে বলা হয় ক্ষিত্তামী। ক্ষিত্তামীর প্রভাবে আসল নামটি চাপা পরে যায়। এক, দুই পুরুষ পর আসল নামটি লোকে ভূলেই যায়।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, অপ্রিয় হলেও সত্য যে- এই ক্ষিত্তামী মুসলমানেরাই বেশী ব্যবহার করে। হিন্দুরা যারা জনসংখ্যার দিক থেকে সন্দ্বীপে দ্বিতীয় স্থানে তারা কেউ কিন্তু ক্ষিত্তামী নামে ডাকেনা।
ক্ষিত্তামী নাম উচ্চারণের সহজীকরন করে তুচ্ছার্থে ডাকা, চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর কিছু অংশ ছাড়া বাংলাদেশের কোথায়ও এসব নাই। যারা এভাবে বলে তাদেরকে আর যাই হোক ভদ্রলোক বলা যায়না। অন্য অঞ্চলের লোকদের এদের সম্বন্ধে নিন্মমানের মানুষ হিসাবে ধারনা সৃষ্টি হয়। সন্দ্বীপের লোকেরা বাংলাদেশের অন্য যে কোন স্থানের লোকদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য-ইন্ডাষ্ট্রি, সাহিত্যকর্ম, উচ্চ-শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ সব পেশায় প্রতিযোগিতা করে সুনামের সাথে কাজ করেন।
শব্দের উচ্চারণগত কারনেই আমরা অন্যদের সমপর্যায়ে আসতে পারছিনা। অবশ্য এটা কোন কঠিন কাজ নয়। কোন পয়সাও খরচা হবেনা। শুধু প্রয়োজন হবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের সচেতনতা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এখানে যে কাজটি করতে হবে সেটি হল- স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলিতে শুদ্ধ বাংলা বলতে বাধ্যতামূলক করা। সমাজের সচেতন লোকদেরকে খেয়াল রাখতে হবে, যেখানে যখনই উচ্চারনগত ব্যত্যয় ঘটবে তখনি শুদ্ধ করে দিয়ে তাকে বাধ্য করতে হবে যেন শুদ্ধ করে কথাটি বলে। অশুদ্ধ কথাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
বাড়ীগুলোকে ক্ষিত্তামী নামে যেন ডাকা না হয় সে জন্য বাড়ীর আসল নাম লিখে বাড়ীর সামনে বাড়ীর মালিক একটি নামফলক টানিয়ে দিবেন। এ কাজটি করতে স্কুল, কলেজ, মাদ্রসার সকল শিক্ষক, কমিটির মেম্বার, সিনিয়র ছাত্র, সমাজের শিক্ষিত, সচেতন সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
সন্দ্বীপকে যারা ভালবাসেন তারা একাজটি অবশ্যই করবেন। এটা আমার বিশ্বাস। সন্দ্বীপের অনেক সমাজসেবী সংগঠন আছে, এ বিষয়টিকে তথা সন্দ্বীপের মানুষের ভাষাগত উচ্চারন শুদ্ধিকরণ অভিযান হিসাবে গ্রহন, ব্যপক প্রচারণা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
সচেতন লোকদের কাছে আমর অনুরোধ, একাজটি কেন করবেন না? আপনারা অনেক জনসেবা এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকেন। একাজটি না করলে আমরা যে Sub Standard হয়ে যাচ্ছি! অথচ আমরা দেশের আর কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে নাই।
এটা আমার অনূভূতি, যা সংক্ষেপে এই লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করলাম। স›ন্দ্বীপকে যারা ভালবাসেন আমার অনূভূতির সাথে তাল মিলিয়ে অভিযানটি সাফল্যমন্ডিত করবেন, এটাই প্রত্যাশা।
-
লেখক : বাংলাদেশ বিমানের সাবেক উপ-প্রধান প্রকৌশলী ও সন্দ্বীপ বিমান বন্দর বাস্তবায়ন পরিষদের আহবায়ক।