আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার, ১১:৫৭ অপরাহ্ন
শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২২   |   sonalisandwip.com
জননেত্রী থেকে বিশ্বনন্দিত নেতা শেখ হাসিনা

ড. সালেহা কাদের

বিশ্বনন্দিত নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে একজন সৎ ও সজ্জন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জননেত্রী থেকে বিশ্বনেতাতে পরিণত হয়েছেন তিনি। বিশ্ব পরিমণ্ডলে অনগ্রসর জাতি-দেশ-জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র-ও তিনি।

১৯৪৭ সালের এই দিনে মধুমতি নদী বিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে তার জন্ম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার প্রথম সন্তান। শেখ হাসিনা গ্রামবাংলার ধুলোমাটি আর সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। যে কারণে মাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড়।

১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এসময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক কাউন্সিল অধিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ডাক আসে দেশ-মাতৃকার হাল ধরার। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর ধরে সামরিক জান্তা, স্বৈরশাসন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চলে একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে টলাতে পারেনি এক বিন্দু।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সরকারের আমলেই ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে। দারিদ্র্য হ্রাস পায়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার প্রথমবারের (১৯৯৬-২০০১) শাসনকাল চিহ্নিত হয় ’৭৫ পরবর্তী সময়ের স্বর্ণযুগ হিসেবে।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ সময় দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে জোট সরকার সারাদেশে কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা-কর্মীকে। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট তদানীন্তন বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারি মদতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে চালানো হয় পরিকল্পিত নারকীয় গ্রেনেড হামলা; যার প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। গুরুতরভাবে আহত হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। বাংলাদেশ পরিণত হয় এক মৃত্যু উপত্যকায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদতে সারাদেশে ধর্মীয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপক উত্থান ঘটে। আর তাদের এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান অকুতোভয় শেখ হাসিনা। বাংলার আপামর মানুষ তার আহ্বানে রাজপথে নেমে আসে।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনের অবসান হলেও সংবিধান লঙ্ঘন করে বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করেন। হাওয়া ভবনের নির্দেশে চলতে থাকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নির্বাচনী প্রহসনের প্রস্তুতি। গর্জে উঠে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। শুরু হয় গণ-আন্দোলন। বাতিল হয় পাতানো নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন ইয়াজউদ্দিন। ঘোষিত হয় জরুরি অবস্থা। ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

১/১১-এর পর শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাসহ দুই প্রধান নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাজির করা হয় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে আসার সময় বেআইনিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সাহসিকা শেখ হাসিনা সরকারি নিষেধাজ্ঞা, ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে ফিরে আসেন প্রিয় স্বদেশভূমিতে। কিন্তু এর মাত্র দু’মাস পর ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই নিজ বাসভবন সূধাসদন থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় একটি অস্থায়ী কারাগারে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক ষড়ন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। কারাগারে তার জীবননাশের ষড়যন্ত্র চলে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে চলতে থাকে গণসংগ্রাম ও আইনি লড়াই। আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন নয়। বদলে যায় দৃশ্যপট। শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন চতুর্থাংশের বেশি আসন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। গঠিত হয় মহাজোট সরকার। শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অমিত সম্ভাবনার শক্তিশালী ভিত রচিত হওয়ায় জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান শেখ হাসিনা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আজ সফলতার সঙ্গে টানা তৃতীয় মেয়াদে ও চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনা করছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সুফল পাচ্ছে আজ দেশবাসী। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সব প্রতিবন্ধকতা, সমস্যা-সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে বিগত এক দশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিনির্মাণের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়েছে অজস্র সাফল্য-স্মারক।

তাঁর শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত, রিজার্ভ মাত্র ৩.৫ বিলিয়ন থেকে রিজার্ভ ৪৮.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, নাগরিকদের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত, ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে উন্নীত ও প্রায় শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনা, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদরাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তিনি নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। করোনা মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। একইসঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছেন কার্যকরী পদক্ষেপ।

দেশের জনগণের জন্য কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে যেসব সম্মানজনক স্বীকৃতি ও পুরস্কার দেওয়া হয় সেগুলো হলো- চ্যাম্পিয়ন্স অব আর্থ, মাদার তেরেসা পদক, মহাত্মা গান্ধী পদক, সেরেস পদক, এমডিজি পুরস্কার, ইন্ধিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার, সাউথ-সাউথ পুরস্কার ও পিস ট্রি।

জন্মদিনে শ্রদ্ধা হে প্রিয় নেত্রী, শতায়ু হউন। আপনার কর্মে আপনি বেঁচে থাকুন বাঙালির হৃদয়ে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।-

লেখক- শিক্ষাবিদ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠক।

[নিবন্ধটি গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিশ্বনন্দিত নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে লেখা।

তথ্যসূত্র- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েভ সাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।