মুফতি মাহফূযুল হক
গ্রামে-গঞ্জের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শতভাগ সুদমুক্ত ঋণ প্রদান মসজিদ ডট লাইফের প্রধান কর্মসূচি হলেও এর রয়েছে সেবা খাতের আরও কিছু কর্মসূচি। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র কৃষক, কৃষাণী, আক্ষরিক অর্থেই স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ী যাদের কোনো ব্যাংক ঋণ দেয় না, তারা যখন চার পাঁচ হাজার টাকার জন্য আটকে পড়ে, জমিতে সার দিতে পারে না, ব্যবসা গোছাতে পারে না, অটো রিকশার ব্যাটারি কিনতে পারে না- তখন বিনাসুদে এই অভাবী মানুষগুলোকে কেউ ঋণ দেয় না। অনেক চড়া সুদে তা-ও আবার চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের টাকা ধার নিতে হয়। সমাজের এই শ্রেণির মানুষগুলোর মুখে মুখে এখন হাসি ফুটাচ্ছে মসজিদ ডট লাইফ। কোনো জামানাত, আপৎকালীন সঞ্চয় ও খরচ ছাড়া এই মানুষগুলোকে মসজিদ ডট লাইফ পাঁচ হাজার থেকে বিশ হাজার পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে।
প্রদত্ত ঋণ সাপ্তাহিক বা দ্বিসাপ্তাহিক বা মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে এতটুকু পরিমাণে আদায় করে যা ঋণ গ্রহীতার জন্য সহজ। কিস্তির মোট পরিমাণ এবং কিস্তির ধরন এবং প্রতিটি কিস্তিতে প্রদেয় পরিমাণ ইত্যাদি নির্ধারণে ঋণ গ্রহীতার সক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। দেশে সুদমুক্ত ঋণ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ২৬টি জেলায় ১০৪টি শাখার মাধ্যমে এর সেবা পরিচালিত হচ্ছে। মসজিদ ডট লাইফের রয়েছে একটি উন্মুক্ত ওয়েবসাইট। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে এর কার্যক্রম, সর্বশেষ অবস্থা যেকোনো ব্যক্তি জানতে পারবেন। দাতারা দেখতে পারেন তার দান বাংলাদেশের কোনো মসজিদের সমাজে বিতরণ হচ্ছে এবং কারা কারা তার দান থেকে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। তাদের ছবি, মোবাইল নম্বর ইত্যাদিও পেয়ে যাবেন। আবার সুবিধাভোগীরা দেখতে পারবেন কী কী সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
মসজিদ ডট লাইফের আয়ের উৎস দুটি দান গ্রহণ ও ঋণ গ্রহণ। এ পর্যন্ত ১৪১ জন দাতা থেকে ২৯ লাখ ৮৫ হাজার ৭১৭ টাকা দান গ্রহণ করা হয়েছে। ২৪ জন ঋণ দাতা থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে ২১ লাখ ৪৭ হাজার ৪০ টাকা। যা থেকে প্রায় ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৫ টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ ডট লাইফ এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩ শত ২৮ জন ঋণ গ্রহীতার মধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে ১ কোটি ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৫১০ টাকা। মসজিদ ডট লাইফের সেবা গ্রহণের অন্যতম শর্ত নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানটির শাখা থাকা। মসজিদ কমিটির সভাপতি, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ যৌথ স্বাক্ষরে নির্ধারিত ফরমে শাখা খোলার ও শাখা কমিটির অনুমোদন দিলে কর্র্তৃপক্ষ শাখার অনুমোদন দেয়। কোনো মহল্লায় বা সমাজে মসজিদ ডট লাইফের শাখা খুললে সেই সমাজের অমুসলিম ও নারীরাও সেবা পান। সেবা প্রদানে ধর্ম বা লিঙ্গ পরিচয়ে কোনো পার্থক্য করা হয় না। এ পর্যন্ত ১৬ জন অমুসলিমের মধ্যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৯০০ টাকা।
মসজিদ ডট লাইফের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য শূন্য ব্যয়। দেশব্যাপী এ কর্মযজ্ঞ চালাতে গিয়ে দাতাদের দানের একটা পয়সা দ্বারা ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করা হয় না। দাতাদের প্রতিটি পয়সা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে পৌঁছে দিতে মসজিদ ডট লাইফের কোনো অফিস নেই, বেতনভুক্ত কোনো লোক নেই। যে মসজিদে শাখা খোলা হয় সেই মসজিদকেই কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জুমার নামাজের পর শাখার সদস্যরা পরামর্শে মিলিত হন। সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায় বা অন্যান্য সেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত ও কাজ অল্প সময়ের মধ্যেই সেরে নেওয়া হয়। যেহেতু জুমার নামাজের পর ইমাম সাহেবের সামনে মসজিদে বসে ঋণ নিচ্ছে সেহেতু মসজিদ ডট লাইফের ঋণখেলাপিও তেমন নেই। মসজিদ ডট লাইফ ঋণ দেয় তাদের যারা সক্ষম। সমাজের যারা অক্ষম তাদের ঋণ দেয় না। বরং তাদের জন্য মসজিদ ডট লাইফের সেবা হচ্ছে, সাহায্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা। এ জন্য তারা প্রতিষ্ঠানের ওয়াবেসাইটে অক্ষম ব্যক্তির ছবি, মোবাইল নম্বরসহ সত্যিকারের প্রয়োজনগ্রস্থ হিসেবে একটি প্রত্যয়নপত্রসহ প্রোফাইল করে দেয়। এটা দেখে দাতারা তাকে সাহায্য করেন। এ পর্যন্ত ১০৪টি শাখা থেকে অক্ষম হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন ২২৮ জন। যাদের মধ্যে দাতাদের পছন্দ অনুপাতে বিতরণ করা হয়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা।
কামাল আহমেদ মসজিদ ডট লাইফের প্রতিষ্ঠাতা। পরিচালনা পর্ষদে আছেন আরও ৬ জন। সবার বিস্তারিত পরিচয় ওয়েবসাইটে দেওয়া। উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন আরও ৯ জন। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশায়, জীবনে, কর্মে সফল ও মানবিক মানুষ। এ ছাড়া রয়েছে মাঠ পর্যায়ের শাখা ব্যবস্থাপনা কমিটি। শেকড় থেকে চূড়া সবাই এখানে পরিশ্রম করেন সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে।