আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার, ০২:০১ পূর্বাহ্ন
বৃহস্পতিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৮   |   sonalisandwip.com
গত রোজার ঈদে মায়ের সঙ্গে পায়েল * সে এখন শুধুই ছবি * ছেলের মৃত্যুর পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও আর চাকরিতে ফেরেননি কাতার প্রবাসী বাবা গোলাম মাওলা

 

পায়েল নেই, তার মাও অসুস্থ। কোরবানী হলেও রান্না হয়নি কোরবানীর মাংস। ঈদ এলেও আনন্দ নেই কারো মনে।

ছেলের মৃত্যুর পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও আর চাকরিতে ফেরেননি কাতার প্রবাসী বাবা গোলাম মাওলা।

তিনি বলেন, পায়েলের মা ডায়েবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। ছেলের শোকে তিনি অনেকটাই শয্যাশায়ী। মঙ্গলবার রাতেও তাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছ। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন।

“পায়েল শেষবার যখন চট্টগ্রামে এসেছিল তখন মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, এবার গরু কত টাকায় কেনা হবে। ওর মা বলেছিল- ‘বাবা, তোমার যেটা পছন্দ’। বড় গরু কিনতে চেয়েছিল পায়েল। কোরবানির সময় আমাদের সবার এবার দেশে থাকার কথা ছিল।”

প্রবাসী বাবা আর বড় ভাই কোরবানির ঈদে বাড়িতে থাকবেন, তাই এবার বড় গরু কেনার বায়না ছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েলের। কিন্তু চট্টগ্রামের এই তরুণ নির্মম হত্যার শিকার হওয়ার এক মাস পর যে ঈদ এল, তার পরিবারের জন্য তা নিয়ে এল কেবল বিষাদ।

পায়েলের বায়নার কথা মনে করে আর তাকে হারানোর বেদনায় এবার পরিবারের কেউ গরু কিনতে হাটে যাননি; ছেলের জন্য শোক করতে করতে শয্যাশায়ী তার মা।

পায়েলের বাবা গোলাম মাওলা বলেন, “এখন আর আমাদের ঘরে ঈদের কোনো আনন্দ নেই। আমরা কেউ এবার হাটে যাইনি। আত্মীয়রা গরু কিনে এনেছে।”

পায়েলের মামা দীপু চৌধুরী বলেন, “ঈদের দিন পায়েলদের বাসায় কোরবানি হয়েছে ঠিক, তবে রান্না হয়নি। পায়েলের মা খুব অসুস্থ; ছেলের শোকে বাবাও কাতর।”

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র পায়েলের বাসা চট্টগ্রামের হালিশহর সিডিএ আবাসিক এলাকায়। গত ২১ জুলাই রাতে দুই বন্ধু আকিবুর রহমান আদর ও মহিউদ্দিনের সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে রওনা হওয়ার পর নিখোঁজ হন তিনি।

দুদিন পর মুন্সিগঞ্জ উপজেলার ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করে গজারিয়া থানা পুলিশ। হানিফ পরিবহনের ওই বাসের সুপারভাইজার জনিকে ঢাকার মতিঝিল এবং চালক জামাল হোসেন ও তার সহকারী ফয়সাল হোসেনকে আরামবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আদালতে তাদের জবানবন্দির বরাতে পুলিশ জানায়, গজারিয়া এলাকায় গাড়ি যানজটে পড়ায় প্রসাব করার কথা বলে বাস থেকে নেমেছিলেন পায়েল। বাস চলতে শুরু করলে তিনি দৌড়ে এসে ওঠার সময় দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সংজ্ঞা হারান। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার বদলে দায় এড়াতে ভাটেরচর সেতু থেকে নিচের খালে ফেলে বাস নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন চালক ও সুপারভাইজার।

পায়েলকে অচেতন অবস্থায় সেতু থেকে খালে ফেলে দেওয়ার আগে পরিচয় লুকাতে হানিফ পরিবহনের বাসের চালক ওই তরুণের মুখ থেঁতলে দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেছে তার পরিবার।

পায়েলের বাবা গোলাম মাওলা ও বড় ভাই গোলাম মোস্তফা কাতার প্রবাসী। বড় ভাইয়ের সন্তান হওয়ার খবরে জুলাই মাসে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন পায়েল। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথেই ঘটে ওই ঘটনা।

বুধবার কোরবানির ঈদের দিন হালিশহর এলাকায় পায়েলদের বাসায় গিয়ে তার মা কোহিনুর বেগমকে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “সেদিন যাওয়ার আগে পায়েল বলেছিল ২০ অগাস্ট আবার আসবে। চট্টগ্রামে সবার সাথে ঈদ করবে। আমার ছেলে তো আর আসবে না।

“তারা আমার ছেলেটাকে এত নির্মমভাবে খুন করল। দুনিয়াতে কোথাও এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমার ছেলের তো কোনো দোষ ছিল না।”

কোহিনুর বলেন, “আমার ছেলেটার মুখ শেষবার আমি একনজর দেখতে পারিনি। তারা সে অবস্থা রাখেনি। ২১ বছর ধরে তিলেতিলে এই ছেলেকে আমি মানুষ করেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। আমার জীবনের সব শেষ।”

মামলা তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ আছে পায়েলের পরিবারে; দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পায়েল হত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

তার বাবা বলেন, “আসামিরা তিনজনই আদালতে জবানবন্দি দিয়ে খুনের কথা স্বীকার করেছে। তবু চার্জশিট দিতে এত দেরি কেন? মনে হয় তারা গড়িমসি করছে।”

পায়েলের মৃত্যুর পর তার মামা গোলাম সরোয়ার্দী বিপ্লব বাদী হয়ে চালক জামাল হোসেন, তার সহকারী ফয়সাল হোসেন ও সুপারভাইজার জনিকে আসামি করে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানায় ওই হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পায়েলের বাবা বলেন, “মামলাটা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিতে আমাদের দাবির বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি এ ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “ছেলে তো আর ফিরে পাব না। আমরা চাই অপরাধীদের এমন শাস্তি হোক যাতে ভবিষ্যতে এভাবে আর কোনো মা-বাবার বুক খালি না হয়।”

মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বলছেন, পায়েল হত্যা মামলার অভিযোগপত্র তারা ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যেই’ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, “আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আরও কিছু প্রস্তুতি প্রয়োজন।

“ময়নাতদন্ত আর ভিসেরা প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। চার্জশিট দেওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই চার্জশিট দেওয়া হবে।”

সুত্র : সিপ্লাস অনলাইন