আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার, ০৪:৩০ পূর্বাহ্ন
মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৮   |   sonalisandwip.com
নামই যখন কাল : আসামি রুবেল বিদেশে, জেল খাটছেন নিরপরাধ রুবেল

সন্দ্বীপ উপজেলা অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল দলের কোচ, 'ইউনিটি ফ্রেন্ডস ক্লাব'-এর সভাপতি, সন্দ্বীপের কৃতী ফুটবলার মো. রুবেলকে সম্প্রতি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে একটি হত্যা মামলায়। রুবেল গ্রেফতারের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ সন্দ্বীপের বিভিন্ন মহল বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে আসলেও আইনের মারপ্যাঁচে ফুটবলার রুবেল এখনও মুক্তি পায়নি। উক্ত বিষয়টি নিয়ে দৈনিক সমকাল আজ একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সন্দ্বীপবাসী ও সোনালী সন্দ্বীপ ডটকমের পাঠকদের জন্য নীচে তা হবহু প্রকাশ করা হল। - সম্পাদক

============================================================

নামই যখন কাল : আসামি রুবেল বিদেশে, জেল খাটছেন নিরপরাধ রুবেল

সারোয়ার সুমন ও আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম  :: রুবেল দু'জন- একজন মো. রুবেল ও অন্যজন সিটি রুবেল। মো. রুবেল কৃতী ফুটবলার। সন্দ্বীপ উপজেলা অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল দলের কোচও তিনি। এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিতি তার। স্থানীয় তরুণদের সংগঠন 'ইউনিটি ফ্রেন্ডস ক্লাব'-এর সভাপতি। সিটি রুবেল হলেন ২০১২ সালে নগরের হালিশহরে খুন হওয়া চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র মাসউদ চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। দু'জনের বাড়িই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে- সন্তোষপুর ও গাছুয়া গ্রামে। গত ১৩ অক্টোবর রাতে মাসউদ হত্যা মামলায় ফুটবলার রুবেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অথচ হত্যা মামলার আসামি সিটি রুবেল সেই হত্যাকাণ্ডের পর পাড়ি দিয়েছেন ইতালি। নাম বিভ্রাটে নিরপরাধ এক তরুণের জেল খাটার ঘটনায় উত্তেজনা বিরাজ করছে এলাকায়।

হালিশহর জে ব্লক ১ নম্বর রোডের পুলের গোড়ায় চট্টগ্রাম কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মাসউদ চৌধুরীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা, ২০১২ সালের ৭ আগস্ট। এ ঘটনায় পরদিন তার চাচা নোয়াব আলী চৌধুরী বাদী হয়ে ৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন হালিশহর থানায়। পুলিশের বিভিন্ন শাখার ছয় কর্মকর্তা তদন্ত করেন মামলাটি। এক পর্যায়ে সেটির তদন্তভার পান চট্টগ্রাম সিআইডির এসআই আবুল কালাম আজাদ। আসামি জাফর ইসলাম পান্নাকে গ্রেফতার করেন তিনি। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন পান্না। সেখানে তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সিটি রুবেলসহ ১৩ জন জড়িত বলে জানান। জবানবন্দিতে আসামিদের কারও বাবার নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করেননি তিনি। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন সিআইডির পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমান। আসামিদের ঠিকানা সংগ্রহ করে তিনি ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র জমা দেন আদালতে। অভিযোগপত্রে সিটি রুবেলের বাবার নাম উল্লেখ করেন ওয়াহাব মাঝি। ঠিকানা সন্দ্বীপ উপজেলার সন্তোষপুর।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের সিটি কলেজে পড়ার কারণে সিটি রুবেল হিসেবে যাকে এলাকার লোকজন চেনেন, তার বাবা মো. জাফর। তার গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলার গাছুয়া হলেও বেড়ে উঠেছেন মামার বাড়ি সন্তোষপুরে। তার মামা সন্তোষপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফুল মিয়া। সিটি রুবেল এখন ইতালি প্রবাসী। সিআইডির পরিদর্শক হাবিবুর রহমান সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে সিটি রুবেলের বাবার নাম ও ঠিকানার স্থলে ফুটবলার মো. রুবেলের বাবার নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। সেখানে সিটি রুবেলের বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫ বছর। অথচ ৬ বছর আগে ২০১২ সালে ঘটনার সময় ফুটবলার মো. রুবেলের বয়স ছিল মাত্র ১৮। ২০১১ সালে স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে উত্তর সন্দ্বীপ কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এখন তার বয়স ২৪। এরপরও বাবার নাম ও ঠিকানা ঠিক থাকায় সিটি রুবেলের পরিবর্তে মো. রুবেলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কলেজের অধ্যক্ষ বলেছেন, 'চট্টগ্রামের হালিশহরে খুনের ঘটনার সময় সন্দ্বীপেই ছিলেন মো. রুবেল, হাজির ছিলেন কলেজেও।'

অভিযোগ উঠেছে, নামের একাংশের মিল থাকায় সিটি রুবেলকে বাঁচাতে ফাঁসানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ফুটবলার রুবেলকে।

এ মামলায় সিটি রুবেল আসামি হলেও তার বাবার নাম ছিল অজ্ঞাত। এ সুযোগে সিটি রুবেলের বাবা হিসেবে লেখা হয়েছে মো. রুবেলের বাবার নাম। এরপর সিটি রুবেলকে বিদেশ পাঠিয়ে মো. রুবেলের নামে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। এছাড়া সিটি রুবেলের স্থলে এ মামলায় মো. রুবেলকে ফাঁসানোর পেছনে চারটি কারণ সমকালের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে- এক. মামলার বাদীর যোগসাজশ, দুই. নাম-ঠিকানা সরবরাহে থানা পুলিশের অবহেলা, তিন. নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাইয়ে তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ও চার. প্রভাবশালী মহলের চাপ। এ বিভ্রাটের জন্য মামলার বাদী, থানা পুলিশ ও তদন্ত কর্মকর্তা পরস্পরকে দুষছেন।

মামলার বাদী নোয়াব আলী বলেন, 'যে রুবেলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাকে আমি মামলায় আসামি করিনি। পুলিশের তদন্তে সিটি রুবেল নামে একজনের নাম এসেছে। পুলিশ মো. রুবেলকে ধরে নিয়ে গেছে। সিআইডি অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। কথা বললে এ ভুল হতো না।'

তবে চার্জশিট দেওয়া সিআইডির সাবেক পরিদর্শক হাবিবুর রহমান বলেন, 'সাক্ষ্য-প্রমাণে যাদের বিরুদ্ধে খুনের সংশ্নিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাদের আসামি করা হয়েছে। বাদী ও বাদীর ভগ্নিপতি মাস্টার মাহফুজ এবং স্থানীয় থানা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে সিটি রুবেলের নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে অভিযোগপত্রে। তারা আমাকে সিটি রুবেলের বাবার নাম ওয়াহাব মাঝি বলে জানিয়েছেন। এখন শুনছি ওয়াহাব মাঝি আসলে ফুটবলার রুবেলের বাবার নাম। বাদী চাইলে আদালতে এফিডেভিট দিয়ে এখন নিরপরাধ রুবেলকে এ মামলা থেকে বাঁচাতে পারেন।'

বাদী নোয়াব আলীর ভগ্নিপতি মো. মাহফুজ বলেন, 'সিআইডি পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা যখন সন্দ্বীপে আসেন, তখন তার সঙ্গে আমি ছিলাম। তাকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতাও করেছি। তবে সিটি রুবেলের বাবার নাম ও ঠিকানা হিসেবে মো. রুবেলের বাবার নাম ও ঠিকানা তদন্ত কর্মকর্তাকে আমি সরবরাহ করিনি। তিনি থানা পুলিশের কাছ থেকে এসব তথ্য নিয়েছেন।'

সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, 'যে সময় তদন্ত হয়েছে তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই সিটি রুবেল। এ ছাড়া ওই এলাকায় আর কোনো রুবেল নেই। বাদীও তাকে সিটি রুবেল হিসেবে শনাক্ত করেছেন। এখন বাদী যদি মনে করেন যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি সিটি রুবেল নন, তাহলে তিনি বিষয়টি আদালতে জানাতে পারেন। নিরপরাধ হলে রুবেল খালাস পেয়ে যাবেন।'

রুবেলকে গ্রেফতার করা সন্দ্বীপ থানার উপপরিদর্শক মো. জায়েদ বলেন, 'ওয়ারেন্টে সিটি রুবেল নাম থাকলেও বাবার নাম লেখা আছে ওয়াহাব মাঝি। ওয়াহাব আসলে মো. রুবেলের বাবা। এলাকার লোকজনের দাবি মো. রুবেল সিটি রুবেল নয়। এলাকার মানুষ মো. রুবেলকে ভালো ছেলে হিসেবে জানে। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে মো. রুবেলকেই গ্রেফতার করতে হয়েছে।'

রুবেলের মা বিবি পরীচান বলেন, 'আমার নিরীহ ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। যে ঘটনায় আমার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তখন সে সন্দ্বীপে কলেজে ছিল। চট্টগ্রাম শহরে যাইওনি তখন। আমার ছেলে ষড়যন্ত্রের শিকার।'

সবশেষে যার কূটচালে রুবেলকে ফাঁসানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সন্তোষপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেই মো. মাকসুদুর রহমান ফুল মিয়া বলেন, 'রুবেল নামে আমার এক ভাগিনা আছে। সে সিটি কলেজে পড়াশোনা করত। থাকত হালিশহরে। ২০১৩ অথবা ২০১৪ সালের দিকে সে ইতালি চলে যায়। চট্টগ্রাম কলেজছাত্র মাসউদ হত্যার সঙ্গে সে কোনোভাবে জড়িত নয়। যে রুবেলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, জড়িত নয় সেও। অভিযোগপত্রে সিটি রুবেলের বয়স ৩৫ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার ৬ বছর পর এখনও সিটি রুবেলের বয়স ৩৫ হয়নি। নিশ্চয় মামলার তদন্তে কোথাও ভুলত্রুটি হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।' চেয়ারম্যানের দাবি- আসামির জবানবন্দিতে সিটি রুবেলের নাম এলেও সে কীভাবে এ খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো তার কোনো বর্ণনা নেই চার্জশিটেও। অথচ এক রুবেল ২ মাস ১০ দিন জেল খেটে এখন জামিনে আছে। আরেক রুবেলকে সিটি রুবেল বানিয়ে জেল খাটাচ্ছে পুলিশ।

উত্তর সন্দ্বীপ কলেজের অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'রুবেল আমার কলেজেরই ছাত্র ছিল। এলাকায় তার কোনো বদনাম নেই। অথচ খুনের ঘটনার সময় রুবেল এলাকায় ছিল, এ প্রমাণও আছে। তার মুক্তির দাবিতে আমরা আন্দোলনে যাব।'

প্রসঙ্গত চট্টগ্রাম কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় মাসউদ চৌধুরী হালিশহর জে ব্লক এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। মেসের পাশে জাফর ইসলাম পান্না নামের এক ব্যক্তির একটি মুদির দোকানে আড্ডা দিতেন মাঝে মধ্যে। ২০১২ সালের ৫ আগস্ট তরল দুধ সরবরাহকারী মহিউদ্দিন কাদেরের সঙ্গে ওই মুদি দোকানির হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে একই বছরের ৭ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে আসামি মহিউদ্দিন কাদেরের নেতৃত্বে ওই দোকানে হামলা চালানো হয়। দোকানি জাফরকে না পেয়ে ৭ থেকে ৮ জন আসামি এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে মাসউদকে।

সুত্র : দৈনিক সমকাল, ২৩.১০.২০১৮