আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ || ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার, ০৬:৩২ অপরাহ্ন
সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০২৪   |   sonalisandwip.com
শ্যাওলা (পর্ব-১) : মোঃ রোকন উদ্দিন সেতু

ভোরের আকাশ একটু ফর্সা হতেই বেরিয়ে পরে শেফালী বেগম, তাঁর ছোট সন্তানটি সাথে নিয়ে | এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ফিরে মানুষের বাড়িতে ছুটা কিছু কাজ করে সকাল আর দুপুরের মা ছেলের খাবার নিশ্চিত করে | সন্ধ্যায় বাড়ী ফেরার সময় গৃহকর্তিরা কাজের বিনিময়ে কয়েকসের চাল, ডাল বা আটা দিয়ে দেয় শেফালী বেগমকে |

শেফালী বেগম এর স্বামী চার ছেলে মেয়ে রেখে গত হয়েছে বছর কয়েক হলো | দুই ছেলে দুই মেয়ে | ছেলে মেয়ের নাম গুলো মিলিয়ে রাখা হয়েছে | দুই ছেলের নাম চাঁদ, সুরুজ আর দুই মেয়ের নাম সোনালী, রুপালি | চাঁদ শহরে রিক্সা চালিয়ে পরিবার নিয়ে কীর্তন খোলা বস্তিতে থাকে | সোনালী স্বামী সংসার নিয়ে পাশের দুই গ্রাম পরে শশুড় বাড়িতে |

শেফালী বেগম বাকি দুই জন সুরুজ আর রুপালিকে নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে দিনাতিপাত করে যাচ্ছে |

মেয়ে জামাই সময় পেলে শশুড় বাড়িতে ছুটে আসে | আর বড় ছেলে চাঁদ মাঝে মাঝে আসে| যাবার বেলায় কিছু সাহায্য সহযোগিতাও করে যায় | ছেলের কাছে , মেয়ে জামাই এর কাছে শেফালী বেগম এর একটাই চাওয়া রুপালিকে কোনো ভাবে পাত্রস্থ করা | কুড়িতে বুড়ি হয়ে যায় মেয়েরা, এই কথাটি শেফালী বেগম এর এক মাত্র চিন্তার কারণ | যদিও রুপালির বয়স ষোল শেষে সতেরতে পড়তে যাচ্ছে |

মায়ের অনুপস্তিতে রূপালী ঘরের কাজ করে সময় পার করে | ঘর গুছিয়ে রাখা, নিজের খাবার ব্যবস্থা করা, বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে জ্বালানির জন্য পাতা কুড়ানো, কাঠ কুড়ানো, মাঝে মাঝে শাক লতা পাতা ইত্যাদি তুলে আনা তাঁর নিত্য নৈর্মিত্তিক কাজ |

একই বাড়িতে আরো তিন চারটি পরিবারের বসবাস | একটি পরিবারে অবস্থা খুবই স্বচ্ছল | ঐ পরিবারের গৃহকর্তার প্রবাসী মুদ্রার বদৌলতে পরিবারের সদস্যদের আয়েশি জীবন যাপন | তিন চার জন গৃহপরিচারক-পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও সেই পরিবারে কাজের শেষ হয়না | তাই মাঝে মাঝে তাঁরা রূপালীকে বিশেষ অনুরোধে সাহায্য করার জন্য ডাকতেন | রুপালি দু'একবার তাঁদের সাহায্য করে অনেক কিছু পেয়েছে, শাড়ি, জামা কাপড় আর ঋতু ভিত্তিক শাকসবজি ফসল আরো অনেক কিছু |

শেফালী বেগম এতে খুশী হতে পারেনা | মেয়েটা তাঁর কারো ঘরে কাজ করুক সেটা সে চায়না | তাছাড়া এই সচ্ছল পরিবারে সচ্ছলতা থাকলেও তাঁদের আচার আচরণ শেফালী বেগমের একদম পছন্দ না | যতটুকু পছন্দ ছিল তাও মুছে গেছে | প্রবাসীরা তিন ভাই | প্রত্যেকের কাছে মানুষের উপরে সত্য হলো টাকা | তার উপরে সত্য নাই | নিম্ন বিত্ত আর মধ্যেবিত্ত মানুষকে তারা মানুষই মনে করেনা | বড় ভাই এর স্ত্রীর সাথে ছোট ভাইয়ের ফস্টি নস্টি স্বচক্ষে দেখে. বড় ভাই মনের দুঃখে বাড়ীর অদূরে কড়াই গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে | সেই থেকে ঐ পরিবারে রুপালির কাজ করা শেফালী বেগমের পছন্দ না | এখনও প্রবাসী ভাইয়ের সমর্থনে ছোট ভাই বহাল তবিয়তে পাড়ায় পাড়ায় অপকর্ম করে বেড়ায় | তাই শেফালী বেগম মেয়েকে কঠিন ভাবে বলে রেখেছে যেন ঐ পরিবারে কোনো কাজ না করে |

বাড়ির পেছনে খোলা মাঠে, আসে পাশের বাড়ীর সম্পর্কের চাচা, জেঠা, ভাইয়েরা গরু চড়াই আর চাষাবাদ করে |

পানির তৃষ্না বা কোন কিছুর প্রয়োজন হলে তাঁরা রূপালীর কাছে চেয়ে নেয় | বয়সে একটু বড় উত্তর বাড়ির রফিক এর বারে বারে পানির তৃষ্ণা পায় রূপালীকে এক নজর দেখার জন্য | রুপালি তা বুঝতে পারে | রুপালি কোন সমস্যায় কিংবা প্রযোজনে সুযোগটি কাজে লাগাই রফিককে দিয়ে | গাছ থেকে নারকেল পেরে নেয়া, দোকান থেকে সদাই পাতি আনিয়ে নেয়া | গাছের শুকনা ডাল গুলো পেড়ে নেয়া সহ অনেক কাজ | রফিকের করতে ভালো লাগে |

রূপালীরও সময় কাটে রফিক এর সাথে গল্প করে | কিন্তু প্রবাসীর ভাই রফিক এর সাথে মেলা মেশাটা পছন্দ করে না | তাই মাঝে মাঝে রূপালীকে ধমকায়, বিভিন্ন কথা শুনায় | শেফালী বেগম কেউকে কথা শুনাতে ছাড়ে না | শেফালী বেগম রফিককে কঠিন ভাবে এই বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দেন |

সোনালীর স্বামী কৃষি কাজ করে তাঁদের সংসার চালায় | ভালো মন্দ কিছু করলে স্বামীকে দিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠায় | সোনালীর স্বামী রাশেদ আনন্দের সাথে তা শশুড় বাড়ীতে নিয়ে আসে | শাশুড়ীর অনুপস্থিতে ঘন্টা দুই এক থেকে আবার বাড়িতে ফিরে যায় |

সময় অসময় রাশেদ প্ৰায় চলে আসে শশুড় বাড়িতে | শশুড় বাড়ীতে তাঁর বেশ ভালো সময় কাটে | প্রবাসীর ছোট ভাই জহির এর সাথে তার ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে | মোটর বাইকের পিছনে বসিয়ে জহির রাশেদকে বিভিন্ন কাজে নিয়ে নিয়ে যায় | রাশেদ এতে খুব সম্মান বোধ করে | তা ছাড়া রূপালী বোন জামাই আসলে পরে যথেষ্ট খাতির যত্ন করে | শেফালী বেগম মাঝে মাঝে কাজ থেকে এসে , জামাইয়ের জন্য রূপালীকে সহযোগিতা করে দিয়ে যায় |

প্রবাসীর ছোট ভাই জহির হটাৎ একদিন রূপালীদের ঘরের সামনে এসে রূপালীকে ডাকতে থাকে তাঁদের ঘরের কাজে একটু সাহায্য করার জন্য | রুপালি ঘরের ভিতর থেকে অপারগতা প্রকাশ করে | জহির বিশেষ ভাবে রুপালিকে অনুরোধ করলে পরে, তাঁর মায়ের কথা মনে পরে | মায়ের কঠিন বারণ, প্রবাসীদের ঘরে কোন কাজ করা যাবে না | সে মায়ের কঠিন নিষেধ এর কথাও বলতে পারে না | কোন উপায় না দেখে সে, জহিরকে বললো

: আমার শরীর টা খারাপ লাগছে, তাই কাজ করতে পারবোনা | জহির কাল বিলম্ব না করে ঘরের ভিতর রুপালির অসুস্থতা দেখতে যায় | প্ৰায় অনেক্ষন সময় পরে জহির, রুপালিকে না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে |

সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা দেখে শেফালী বেগম মেয়েকে বলে যায়, আজ বৃষ্টি হতে পারে, ঘরের বাহিরের কাজ গুলো ঠিক মতো করে রাখতে | রুপালি বাহিরে রাখা শুকনো লাকড়ি, গাছের পাতা, মাটির তৈরি চুলো আরো অন্য সব জিনিস পত্তর গুছিয়ে রাখতেই জুম বৃষ্টি শুরু হলো |

এই বৃষ্টিতে ভিজে একটু দূর হতে নল কূপের পানি আনতে যায় রুপালি | পথি মধ্যে রফিককে দেখে জাল মেরে মাছ ধরতে | সে নিজের ভেজা শরীরের কাপড় ঠিক করে দ্রুত পানি নিয়ে ফিরে আসতে, পেছন থেকে রফিক ডাক দেয়।

রুপালি কথা না বলেই দ্রুত ফিরে আসে ঘরে | রফিক বুঝতে পারছেনা কি তার অপরাধ | শেফালী কাকী বাড়িতে যেতে বারণ করেছে, আজ রুপালি কোন কথা না বলেই চলে গেলো | বিষয়টা আমাকে জানতেই হবে |

এই ভেবে রফিক রুপালিদের বাড়িতে আসে | যদিও আসে পাশে কেউ নেই এই বৃষ্টিতে | সে সোজা ঢুকে পরে রূপালীদের ঘরে | জানতে চায় তাঁর অপরাধ | হটাৎ রফিককে দেখে রুপালি জড়ো সরো ভাবে বসে পরে | তার শরীরের ভিজা কাপড় বদলাতে রফিক ঢুকে পরে | রুপালিকে দেখে রফিক নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা | বৃষ্টি ভেজা শরীরে ভিন্ন এক রুপালিকে দেখছে | রুপালি চিৎকার করে রফিককে বেরিয়ে যেতে বলছে | বাইরের বৃষ্টির গতিবেগ এতো বেড়েছে, বাড়ির মানুষ কেন সামনে দাঁড়ানো রফিক ও রূপালীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছেনা

রফিক চলে যায় |

রুপালি ক্লান্ত শরীরে উঠে দেখে বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে | চার দিকটা সন্ধ্যা নেমে এসেছে | শেফালী বেগম এর আসার সময় হয়েছে । রুপালি পুকুর ঘাটে যায় | ফিরে এসে চুলোয় আগুন দিয়ে ভাতের চাল বসায় | চুলোর পাশে বসে এক দৃষ্টিতে আগুন দেখে, আর নিজেদের দারিদ্রতা নিয়ে ভাবতে থাকে | মায়ের কষ্ট নিয়ে ভাবে | সারা দিন মায়ের সান্নিধ্য না পাওয়ার কষ্ট তাঁর বুকটা হু হু করে উঠে | ছোট ভাইটাকে কাছে রাখা যায়না, মায়ের সাথে দু’বেলা দু’মুঠো ভালো খেতে পারবে বলে | এই সব ভাবতে যেয়ে ঘরের দরজায় শব্দ শুনে বুঝলো মা এসেছে |

দরজা খুলতেই দেখে বোন আর বোনের জামাই সামনে দাঁড়িয়ে | আনন্দে সে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে: এই বৃষ্টিতে তোমার আসার সময় হলো ?

: তোর দুলাভাই বললো তাই চলে এলাম | মা কোথায়রে ?

: মা এক্ষনি চলে আসবে,. তুমি বসো |

: তাহলে আমি পাশের ঘরের দাদিকে একটু দেখে আসি, তুই তোর দুলা ভাইয়ের সাথে বসে একটু কথা বল

: এখন না গেলে হয়না ? মা আসুক তারপর যেও |

রাশেদ বললো যেতে চায় যখন যাকনা | তুমি আমার সাথে বসে কথা বলো | বৃষ্টি না থাকলে আমরা দুপুরের পরেই আসতাম | আমরা বেশিক্ষন থাকবো না | তোমারে দেখতে মন চাইলো তাই চলে আসলাম |

: সেতো বুঝতেই পারছি, তা না হলে এই বৃষ্টির দিনে আপন মানুষ ছাড়া কেউ আসে ?

সোনালী বেড় হতে যাবে ঠিক সেই সময় শেফালী বেগম মেয়েকে দেখে অবাক হয় | মা আসছে দেখে রুপালি অনেকটা নিশ্চিন্ত হয় | সোনালির সাথে একটু কথা বলেই মেয়ে জামাইকে বললো :

এই বৃষ্টির দিনে কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল বাবা ?

রাশেদ শেফালী বেগমকে সালাম করে বললো :

মা আমি তো প্রায় আসি, আপনার সাথে দেখা হয়না ?

: তা ঠিক, এই বার কয়েকদিন পরে আসলে | বাড়ির সবাই ভালো আছেতো ?

: জী আছে | আমরা বেশিক্ষন বসবোনা | আপনার মেয়ে আপনাদের দেখতে চাইলো, তাই নিয়ে আসলাম |

স্বামীর এমন কথায় সোনালী হাসলো | মনে মনে বললো আমার চেয়ে তোমার বেশি ইচ্ছে ছিল।  শশুড় বাড়িতে আসার জন্য এতো পাগল মানুষ আমি আর দেখিনি | যদিও সোনালীর ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে |

কিছু দিন ধরে রুপালি খুব অসুস্থ | শেফালী বেগম তেমন একটা কাজও করতে পারেনা | যারা খুব বেশী বিপদে পরে তাঁদের অনুরোধে শেফালী বেগম দুই তিন ঘন্টার জন্য কাজ করে দিয়ে আসে | রফিক মাঠে কাজ করার সময় অপেক্ষাই থাকে কখন শেফালী বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যায় | সেই সুযোগে চার পাশ টা ভালো ভাবে দেখে বেড়ার ফাঁক দিয়ে কিংবা সরাসরি রুপালির সাথে দেখা করে যায় | রফিক এর এই আসা যাওয়া রূপালীর ভয় হয় | তবু পাড়া প্রতিবেশীরা দেখবে বলে রফিককে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে নেয় | যেন কেউ না দেখে |

অন্য দিকে, প্রবাসীর ভাই জহির রূপালীর অসুস্থতার উছিলায় বারে বারে সহানুভূতি দেখাতে আসে | বোনের জামাই যে দিন আসে সেই দিন শেফালী বেগম এর একটু বাইরে কাজ করার সুযোগ হয় | রুপালি মাকে কাজ করতে বারণ করেও লাভ হয়না | রূপালীর শুধু মনে হতে লাগলো এমন কিছু কথা আছে বলাও যায়না আবার না বলে থাকাও যায়না | দারিদ্র্যের কষাঘাতে সব কিছু আড়াল থেকে যায় |

কিছু বিষয় কখনো আড়াল করার ইচ্ছে থাকলেও আড়াল হবার নয় |

আরো কিছুদিন যেতেই রূপালীর শরীর আরো খারাপ হতে লাগলো | এতো বেশি ক্লান্ত হয়ে পরে সারাক্ষন তাঁর ঘুমাতে ইচ্ছে হয় | সবাই ধরে নিলো বৃষ্টিতে ভিজে এই রোগ বাঁধিয়াছে | শেফালী বেগম তাঁর সামর্থ অনুযায়ী বনজ ঔষধ আর হুজুরের পানি পড়া তেল পড়া চিকিৎসা দিয়েই যাচ্ছে।

কোন কিছুতে তাঁর রোগ ভালো হচ্ছেনা | শেফালী বেগম কোনো উপায় না দেখে ঘরে জমানো টাকা দিয়ে উপজেলা শহরে ডাক্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয় | এক মাত্র ভরসা মেয়ে জামাই রাশেদ তাকেই নিয়ে যেতে হবে, শহরের ডাক্তার এর কাছে |

রাশেদ রূপালীকে নিয়ে আসে ডাক্তার এর কাছে | ডাক্তার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলে আপনারা একটু বাহিরে বসুন-

কিছুক্ষন পর ডাক্তার এর সহকারী রাশেদকে ভিতরে ডাকেন,.অভিনন্দন জানিয়ে ডাক্তার বলেন আপনি বাবা হতে চলেছেন | ডাক্তার ভেবেছিলো রাশেদ আর রুপালি স্বামী-স্ত্রী . রাশেদ এর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।

রাশেদকে চুপ থাকতে দেখে, ডাক্তার বললো- ঘাবড়াবার কিছু নেই | মাত্র মাস দুই/তিন হতে পারে | পরবর্তী রিপোর্ট দেখে সব বলা যাবে | এখন আপনার স্ত্রীর প্রয়োজন বিশ্রাম নেয়া আর যত্নে রাখা |

কথা গুলো শুনে রাশেদ বুঝতে পারছেনা কি করবে এখন ! সে ডাক্তার এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, রুপালিকে সাথে করে দূরে একটু নির্জন জায়গাতে বসলো | এই কথা সেই কথা বলার পর সে বললো-

তেমন কিছু হয়নি পেটে গ্যাস জমেছে বলে ধারণা করছে |

তার পরও শহরে নিয়ে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে পারলে ভাল হবে এই কথাই বললো | দেখা যাক চাঁদ ভাইকে খবর দিয়ে তোমারে শহরে নিয়ে যাবো | রাশেদ খুব নিপুন ভাবে বিষয়টি রূপালীর কাছে এড়িয়ে গেলো | আর মনে মনে ভাবলো রূপালীর এখন কি হবে ?

রূপালীকে শশুড় বাড়িতে রেখে রাশেদ চলে যায় | যাবার বেলায় শেফালী বেগমকে বলে যায় তেমন কিছু না, যে ভাবে বলেছিলো রূপালীকে | শেফালী বেগম রাশেদকে খাবার খেয়ে যেতে বললেও সে খাবেনা বলে চলে যায় | রূপালী ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পরে |

কিছুদিন পর রুপালি তাঁর গর্ভে প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করলো | শেফালী বেগমের রূপালীর অবয়ব দেখে বুঝতে বাকি থাকেনা, যে রূপালী সন্তান সম্ভবা |

একদিন রাতে মেয়ের চুলের মুষ্ঠি ধরে জানতে চাই কে এই সর্বনাশ করেছে তাঁর | কোনো উত্তর না পেয়ে শরীরে আঘাত করে করে জানতে চাই কে এই সন্তানের পিতা | রূপালী বুঝতে পারছেনা কি বলবে | রুপালি যতই চুপ থাকে শেফালী ততোই আঘাত করে যাচ্ছে | শেফালী বেগমের একটাই কথা।

আত্মহত্যা করা ছাড়া তাঁর কোনো পথ নেই |

শেফালী বেগমের মনে পরে যায় প্রবাসীর ভাই এর কথা | চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই জুলন্ত লাশ | যে লাশ দেখার জন্য শত শত মানুষের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা | তাঁদের মুখে মুখে সত্য ঘটনার সাথে, মন গড়া নানান ঘটনার গল্প আলাপ | যা ভাবলে শেফালী বেগমের গা ঘিন ঘিন করে উঠে | মা মেয়েকে নিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে শেফালী বেগম |

অসুস্থ শরীরে আঘাত সইতে না পেরে রুপালি চিৎকার করে বলছে, আমি কার কথা বলবো ? তুমি বুঝতে পারছোনা রাশেদ ভাই কেন সেই দিনের পর থেকে আমাদের বাড়িতে আসেনা ! জহির এর মতো বলদা লোকের হাত থেকে আমারে কে বাচাইবো | তাঁদের ঘরে আমারে কাজ করার জন্য ডাকতে আসে | আমি বললাম আমার শরীর খারাপ কাজ করতে পারবোনা | অসুখ করছে কিনা এইটা দেখার জন্য ঘরে ঢুকে আমারে লইয়া কি না করলো | রাশেদ ভাইরে কত বারণ করলাম | আমারে কয় বেশি বাড়াবাড়ি করলে সোনালী বুবুরে খেদাইয়া দিবো | এখন আমারে কও আমি কি করতে পারি?

অভাবের তাড়নায় তোমারে কাছে পাই না | এই অভাব, বোনের সংসার, জহির মিয়ার দাপট আমার উপর দিয়ে গেছে দিনের পর দিন | আজ এই অবস্থা না হইলে ঐ বদমাইশ গুলার সাথে এখনো আমারে যুদ্ধ করন লাগতো | রুপালি রফিককে নিয়ে কোনো কথা বলেনা | তাঁর কাছে মনে হলো যা হারাবার ছিল তা তো সে অনেক আগেই হারিয়েছে | কিনতু রফিকের কাছে হারাবার কিছুই ছিলোনা, যেখানে কিছুটা ভালোবাসা ছিল | সেই ভালোবাসায় কোনো পাপ ছিলোনা |

শেফালী বেগম পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে | কোনো উত্তর তাঁর জানা নাই | মেয়েকে রফিক এর কথা বলে, জানতে চাই, সে কেন আসতো ? রুপালি মাথা নিচু করে বললো, সে আমারে ভালোবাসে, তাঁর মনে কোনো পাপ নাই | শেফালী বেগম বলে, আচ্ছা তা হলে সে তোমারে ছুঁইয়া দেখে নাই ? রুপালি নিশ্চুপ | তাঁর মনে শরৎচন্দ্রের সেই কথার উত্তর -  " আমি তারে ভালোবাসি অস্থি মাংস সহ আমি নাহি বুঝি পাপ নাহি বুঝি অভিশাপ"

কিন্তু এই কথা গুলো সময় এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মাকে বলবার বিন্দু মাত্র সাহস তাঁর নাই | রুপালি ভাবছে কেন সে রফিক এর কথা বলবে, যা কিছু হারাবার তাতো সে জহির রাশেদদের মতো আপন জনদের কাছে হারিয়েছে | আর রফিক এর কাছে যা হারাবার সেতো ভালোবাসা আর ভালোলাগা ছিল | তাই সে নিশ্চুপ মাথা নত করে চোঁখের জলে ভাসছে |

ভয়ঙ্কর মূর্তি রূপ ধারণ করে শেফালী বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে জহিরকে ডাকতে থাকে | জহির বাহিরে আসলে পড়ে শেফালী বেগম বলে~ নিজের আপন ভাই গলায় কেন দড়ি দিয়েছে তা সবাই জানে, তুমিও জানো |

এর পরেও আমার মাইয়াটার সর্বনাশ না করলে কি হতো না ? এখন আমার মাইটার কি হইবো ?

জহির একটু থমকে গিয়ে বলে কি হয়েছে রূপালীর ?

যা হবার তাই হয়েছে | এখন এই বাড়িতে আবার মা আর মেয়ের গলায় দড়ি দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে | জহির ভয় পেয়ে বললো: চাচি যা হবারতো তো হয়ে গেছে | তোমাদের গলায় দড়ি দিতে হবেনা | যত টাকা লাগে আমি দেবো | তুমি রাশেদকে দিয়ে এর একটা ব্যবস্থা করো |

শেফালী বেগম শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় | তাঁর উপর রাশেদ এর নামটি নেয়াতে নিজেকে আর সংযত করতে পারলো না |

জহির চার দিকটা দেখে ঘরে ফিরে যেতে পা বাড়ায় | শেফালী বেগম বলে যায়, এই বাড়িতে আর কোনো লাশ ঝুলবেনা, আমার মেয়ের জীবন বিনা দোষে নষ্ট হইতে দিমুনা | কথাটা মনে রাখিস | কথা গুলো যদিও বলেছে শেফালী বেগম- কিনতু সে ভালো করে জানে, জহিরের মতো মানুষদের সে কিছুই করতে পারবেনা | তবুও জহিরের প্রতিটা মুহূর্ত কাটে ভয় আর শঙ্কায় |

রাশেদ এখন আর শশুর বাড়িতে আসতে চাইনা কেন ? সোনালী জিজ্ঞেস করে |রাশেদ ভয়ে এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায় | আর মনে মনে ভাবে সে কি করে রূপালীর সর্বনাশের কথা বলবে !

রুপালির শারীরিক পরিবর্তন আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছে | শেফালী বেগম রাশেদকে খবর পাঠালেও আসেনা দেখে নিজে সোনালীর বাড়িতে যায় | রাশেদকে কিছু না বলে শুধু অনুরোধ করে- তাঁদের একটু বড় ছেলে চাঁদ এর কাছে নিয়ে যেতে | রাশেদ মাথা নিচু করে রাজি হয়।

শেফালী বেগম মনের কষ্টে মেয়ের বাড়িতে কিছু না খেয়ে শুধু বলে আসে- ঘরের শত্রু যখন বিভীষণ হয়, তখন কারো কিছু করার থাকেনা | নিজের দিকে খেয়াল রাখিস | এই রকম কথা বলার মানে রাশেদ বুঝতে পারে | কিনতু সোনালী তা বুঝতে পারেনা |

হটাৎ মা আর ভাই বোনদের দেখে চাঁদ অবাক হয় | কারণ প্রথম বারের মতো মা আর ভাইবোনের শহরে আসা | তাও কোনো খবর না দিয়ে | চাঁদের বউ জরি অবাক হওয়ার পাশাপাশি বেশ আনন্দিত | সে শাশুড়ীকে সালাম করে দেবর ননদ নিয়ে বেশ উচ্ছাসিত |

অন্য দিকে চাঁদ ব্যস্ত হয়ে পরে বোনের জামাই রাশেদকে নিয়ে | কিনতু রাশেদ বাহিরে আনন্দ প্রকাশ করলেও মনে মনে শতবার মরে | সে চাঁদকে জানায় আজ রাতের গাড়িতে তাকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে |. তা না হলে জমির চাষ নিয়ে তাকে সমস্যায় পড়তে হবে |

শেফালী বেগম চাঁদকে সব কিছু খুলে বলে | অসহায় বোনের দিকে তাকিয়ে সব কিছু হজম করে নেয় | চাঁদের বউ শাশুড়িকে পেয়ে মহা খুশী | রূপালীর বিষয়টি নিয়ে তাঁর কোনো মাথা ব্যথা নেই | কারণ সে রূপালীর কোনো দোষ খুঁজে পাইনি | যদিও শেফালী বেগম রাশেদ এর কথা বলেনি, বলেছে জহির আর রফিক এর কথা | রফিক এর কথা শুনে চাঁদ একটু নড়ে চড়ে উঠে |

মা কে সে বলে - তা হলে গ্রামের কিছু লোক ডেকে বিচার বসিয়ে, রফিক এর সাথে বিয়ের একটা ব্যবস্থা করলে হয় ! এতে জহিরও নিজেকে বাঁচাতে আমাদের সমর্থন দেবে |

: কিনতু রুপালি তাঁর নাম স্বীকার করতে চাইনা .

: আমরা তাঁকে বুঝিয়ে বলব

: আমি জানি সে রাজি হবেনা, তা ছাড়া বিচার ডেকে যদি কাজ না হয়, তখন কি হবে? গ্রামের মানুষ এখনও কিছু জানে না | তাঁর আগেই আমি তোর কাছে ওরে নিয়ে আসছি |

এই পরিস্থিতে রফিক যদি রাজি না হয় ? তখন কি হবে ?

আমরা তো জানি না এই এই সন্তান কার ?

সমস্যা সমাধানের জন্য সময়ের সাথে রূপালীর গর্বের সন্তানটি বড় হতে থাকে | রুপালি অন্য এক অনুভূতি অনুভব করছে শত কষ্টের মাঝে | মা ভাই আর ভাবীদের সিদ্ধান্ত হলো তাঁরা রূপালীর বাচ্চাটি কোনো ডাক্তারকে দিয়ে ফেলে দিবে | কিনতু রূপালী বাচ্চাটি নষ্ট করতে রাজি না | ফলশ্রুতিতে মা ভাই আর ভাবীর কাছ থেকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে |

একটা সময় রূপালীর ভাবি জরি তাঁকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করে | ব্যার্থ হয়ে সে রূপালীকে সমর্থন করে | জরি তাঁর স্বামী আর শাশুড়ীকে বিষয়টি মেনে নিতে বলে | তা ছাড়া বাচ্চাটি এই সময় নষ্ট করতে গেলে পরে অনেক সমস্যাও হতে পারে | এই রকম অনেক কিছু বলে জরি বিষয়টিকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে | অনেক চিন্তা ভাবনায় সবাই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় | বাচ্চা প্রসব হলে বাচ্চাটি তাঁরা কাউকে দত্তক দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যাবে |

গ্রামের মানুষ সবাই বলাবলি করছে , হটাৎ করে শেফালী বেগম কোনো প্রস্তুতি ছাড়া কেন শহরে চলে গেলো | অনেকে জহির এর দিকে আঙ্গুল তুলছে . হয়তো জহির এর বদ নজর থেকে মেয়েকে বাঁচাতে শহরে চলে যাওয়া |

জহির শেফালী বেগম এর হাতে চড় খেয়ে, প্রতি মুহূর্তে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছে | কখন শেফালী বেগম রুপালি আর বাচ্চাটি নিয়ে সবার সামনে হাজিরহয় | আগের মতো জহির আর এ দিক সেই দিক ঘুরে বেড়ায়না | জহিরের এই পরিবর্তন অনেকে শেফালী বেগম এর শহরে চলে যাওয়ার সাথে সংযুক্ত করে কথা বলছে |

রাশেদ শেফালী বেগম আর রুপালিকে শহরে রেখে আসার পর থেকে, কোনো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেনি | রাশেদের এই রকম নিশ্চুপ থাকা নিয়ে সোনালীর সাথে অনেক বার কথা কাটা কাটি হয় | রাশেদ সব সময় বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে |

সোনালী কিছুতেই বুঝতে পারছেনা রাশেদের এমন পরিবর্তনের কারণ | যে মানুষ শশুর বাড়ির কথা শুনলে আনন্দে লাফিয়ে উঠতো, সে কিনা আজ তাঁদের সম্পর্কে কোনো কথায় শুনতে পারছেনা বিষয়টি সোনালীকে দিন রাত ভাবিয়ে তুলে |

সোনালী মা আর ভাই এর সাথে নিজ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগা যোগ করলেও সন্তোষ জনক উত্তর মিলেনি | তাঁরা ভালো আছে, রূপালীর চিকিৎসা শেষ হলে গ্রামে ফিরে আসবে | শুধু এতটুকু জানতে পারা | কিনতু কি হয়েছে তা সঠিক ভাবে জানতে পারছেনা | স্বামীর সাথে অভিমান করে আর তেমন কিছু জানার চেষ্টাও করছেনা |

রফিক প্রতি দিন মাঠে আসে | তীর্থের কাকের মতো রূপালীদের ঘরটির দিকে তাকিয়ে থাকে | নিজেকে নিজে নানান প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে পাইনা রফিক, কেন হটাৎ করে রূপালীরা শহরে চলে গেলো | যাবার কয়েক দিন আগেও রূপালীর সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল | তখনো কিছু বললোনা, শুধু বললো তাঁর দিন দিন শরীর খারাপ হচ্ছে | তাঁর কিছুই ভালো লাগেনা | তা হলে কি রূপালীর বড় কোন ধরণের অসুখ হলো ? সেই জন্যই কি তাঁদের হটাৎ চলে যাওয়া ? না কি অন্য কিছু ? রূপালীর বিয়ের ঠিক ঠাক হলোনাতো ?

এই রকম অনেক প্রশ্ন নিজেকে করে রফিক ক্লান্ত হয়ে পরে |

একটা দীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলে দূরের আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে | মনে মনে বলে রুপালি তুমি তাড়া তাড়ি গ্রামে ফিরে আসো | আমার যে কিছুই ভালো লাগেনা .....চলবে