আজ সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ || ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ সোমবার, ০৭:৩৯ পূর্বাহ্ন
বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৩   |   sonalisandwip.com
অধ্যাপক আহমদ হোসেন স্মরনে - ড: অনুপম সেন

অধ্যাপক আহমদ হোসেনে চট্টগ্রামের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে এক অবিস্মরণীয় ব্যাক্তিত্ত¡। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি ছাত্রদের সাথে বাংলা ভাষার দাবীতে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সিটি কলেজের বাংলার শিক্ষক-আর চট্টগ্রামের সিটি কলেজ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নে আন্দোল সংগ্রামের মুল কেন্দ্র। এই সময় সংস্কৃতি মনা অধ্যাপক আহমদ হোসেন-মুক্তি সংগ্রামে বাঙালীকে প্রেরণা যোগাতে গীতি নাট্য, সংগ্রামী পথ নাটক লিখতেন-যা ১৯৬৯-৭০ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মুক্ত মঞ্চে প্রদর্শিত হতো।

অধ্যাপক আহমদ হোসেন চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সিটি কলেজের জন্মলগ্ন হতেই এর সাথে যুক্ত ছিলেন। যে কয়েকজন ব্যাক্তির নিরলস পরিশ্রমে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ গড়ে উঠেছিলো-তন্মধ্যে তিনি অন্যতম। এক সময় সিটি কলেজ আন্দরকিল্লা মোড়ে ছিল, পরে স্থানান্তর হয়ে আইস ফ্যাক্টরী রোড়ে চলে আসে।

এই কলেজ এর সূচনা লগ্নে অধিকাংশ শিক্ষকই প্রায় বিনা বেতনে শিক্ষা দান করতেন। শিক্ষকতা জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে তাঁরা এই কাজটি করতেন। আহমেদ হোসেন  শিক্ষকতা জীবনে ব্রতী হয়েছিলেন এই বৃত্তির প্রতি গভীর অনুরাগের বশবর্তী হয়েই। আমৃত্যু শিক্ষাই ছিল তারঁ প্রথম ভালবাসা।
    ১৯৬৪ সালে তারঁ সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুত্রপাত ঘটে। যখন আমি সিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ, আমার কলেজ জীবনের শিক্ষাগুরু অধ্যাপক রেজাউল করিম এর অনুরোধে সেই কলেজে বিনা বেতনে কিছুকালের জন্য অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করি। এম.এ পরীক্ষা দিয়েই আমি সিটি কলেজে যোগ দিই এবং সেই পরীক্ষা ফল প্রকাশের কিছুদিন পরে Buet (Bangladesh University of Engineering and Technology) এ সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান এর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। চট্টগ্রাম সিটি কলেজে তাই আমার অবস্থান খুব দীর্ঘকালের ছিলো না। কিন্তু এর মধ্যে অনেকের সাথে গভীর সৌহ্যর্দ্যরে ও সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ হই-তার মধ্যে আহমদ হোসেন অন্যতম। তিনি আজ আর নেই। তার মতো সৃজনশীল, সাহসী, শিক্ষানুরাগী মানুষ এই সমাজে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে সমাজের উপকার হতো। দীর্ঘ অসুস্থতা ও অকাল মৃত্যু সত্বেও-শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারে তিনি যে ভুমিকা রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর স্মৃতি আমার অন্তরে অ¤øান হয়ে রয়েছে।
    ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে তিনি প্রায় আমার বাসায় আসতেন, এমনকি আমি না থাকলেও। আমার মাকে তিনি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন। বলতেন মাসিমার সাথে কথা বললে আমার মন ভরে উঠে। আপনাদের চেয়ে তাঁর সাথে কথা বলে আমি বেশি আনন্দ পাই। মার কাছ থেকে তিনি চট্টগ্রাম শহরের পুরোনো দিনের কথা শুনতে খুবই ভালোবাসতেন। মা-ও তাঁকে পেলে কিভাবে চট্টগ্রামে চা-খাওয়ার প্রচলন হলো, উদয় শষ্কর  চট্টগ্রামে এসে কোথায় নেচে ছিলেন, আগেকার দিনে চট্টগ্রামে আসা সার্কাস দলগুলোর  নৈপূন্য ইত্যাদি অনেক কথা বলতেন।
    তিনি অনেকবার আমাকে বলেছিলেন, মাসিমার কাছ থেকে চট্টগ্রাম শহরের  এসব পুরনো তথ্য জেনে নিয়ে লিখে রাখা উচিত। এই ঔচিত্যের কাজটি আমি করতে পারিনি। আজ মনে হয়, খুব একটা বড় ভুল করেছি। মাও আজ নেই।

অধ্যাপক আহমদ হোসেনও লোকান্তরিত। ১৯৯৩ সালের ১৭ই জানুয়ারি মা যখন ইহধাম ত্যাগ করেন সেই সংবাদ পেয়ে অধ্যাপক আহমদ ছুটে এসেছিলেন।  তিনি দৈনিক “আজাদী” পত্রিকায় মা’র স্মৃতিচারণ করে অনবদ্য ভাষায় একটি অসাধারণ প্রবন্ধ রচনা করেন। এই প্রবন্ধটি আমার কাছে এক অক্ষয় সম্পদ।
    অধ্যাপক আহমদ হোসেনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়াত বাদশা মিঞা চৌধুরীর সাথে তিনিও থাকতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও তা পশ্চিম পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুমিল্লায় স্থানান্তরের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যায়। অধ্যাপক আহমদ হোসেন এর প্রতিবাদে তার ছাত্রদের নিয়ে মিছিল সভা সমাবেশ শুরু করেন। মরহুম বাদশা মিঞা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক আহমদ হোসেন কে আহŸায়ক করে “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম কমিটি” গঠন করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করা, পশ্চিম পাকিস্তানে তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে স্মারকলিপি দেওয়া প্রভৃতি নানাকাজ তিনি করেছেন সফল ভাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার ও মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর ভূমিকা সঠিকভাবে আমরা তুলে ধরতে পারিনি-তরুন প্রজন্ম এই সম্পর্কে  কিছুই জানে না।

অধ্যাপক আহমদ হোসেনের সবচেয়ে বড় কাজ আইস ফ্যাক্টরী রোড়ে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি মহিলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা। চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটা মহিলা কলেজ রয়েছে-তাছাড়া চট্টগ্রাম কলেজ, মহসীন কলেজ, কমার্স কলেজ এবং সিটি কলেজও মেয়েদের সহশিক্ষার ব্যবস্থা চালু ছিলো। কিন্ত ছাত্রী সংখ্যা ছিল খুবই কম। এই কলেজগুলোতে ছাত্রী যোগান দিবে কারা, যদি মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুলই না থাকে-কারন তখন অনেকেই সহশিক্ষার কারনে মেয়েদেরকে ছেলেদের সাথে একই স্কুলে দিতে চাইতেন না।

সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে-অধ্যাপক আহমদ হোসেন এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নারী শিক্ষার প্রসারে যথার্থ আগ্রহী ছিলেন বলেই তিনি উর্দু ভাষাভাষীদের শিক্ষার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত  ইসলামী স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনটিকে একটি মেয়েদের স্কুলে রূপান্তরিত করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সিটি কলেজের অনেকের কাছ থেকে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে।

কারণ তাঁরা চেয়েছিলেন,  এই পরিত্যক্ত  ভবনটি সিটি  কলেজের মহিলা শাখা করা এবং এ কাজটির ভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা মহিলা স্কুলে রূপান্তরিত করেন। এখানেই তাঁর সুদূর প্রসারী দৃষ্টির পরিচয়। সিটি মহিলা স্কুলটি আজ একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারী  মহিলা স্কুল, যেখানে প্রায় এক হাজার মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে অধ্যাপক আহমদ হোসেন এর আগ্রহ যে কত গভীর ও তীব্র ছিল এ স্কুলটা তারই সাক্ষ্য বহন করে। এটি তাঁর নশ্বর জীবনে অনশ্বর সৃষ্টি। অধ্যাপক আহমদ হোসেন তার কর্মের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

লেখক: ড: অনুপম সেন, উপাচার্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।