আজ সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ || ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ সোমবার, ১০:০০ পূর্বাহ্ন
সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪   |   sonalisandwip.com
সন্দ্বীপে ষ্টীমার যাত্রা : সারোয়ার জাহান জামীল

ফেইসবুকে দেখি বাংলাদেশে এবার শীতের প্রকোপে সবাই অস্থির। মাঘের শীতে না কি বাঘ পালায়। কিন্তু বাংলাদেশের শীতকালের কথা মনে হলে আমার মনটা ছোটোবেলার মধুর স্মৃতিতে ভরে যায়।

আমাদের গ্রামের বাড়ি বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সন্দ্বীপে।

মনে পড়ে, ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষা শেষ হলেই গ্রামের বাড়ি থেকে দাদা-নানা বা চাচা-মামারা কেউ এসে হাজির হতেন আমাদেরকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আনন্দ উত্তেজনায় মনটা চঞ্চল হয়ে উঠতো। সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হলো চট্টগ্রাম থেকে স্টীমারে সন্দ্বীপ যাত্রা।

সন্দ্বীপ যাওয়ার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে তখন দুটো কোম্পানীর মালিকানায় এই জাহাজ চলতো। এগুলো চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ, হাতিয়া হয়ে বরিশাল যেতো। একটা কম্পানির নাম ছিল আর, এস, এন কম্পানি যার পুরো নাম হলো রিভার ষ্টীমার নেভিগেশান। এদের জাহাজগুলোর অদ্ভুত নাম ছিলো যেমন নলচিরা, বাদুরা ইত্যাদি।

পরে জানলাম এগুলো বরিশালের বিভিন্ন যায়গার নাম। এদের চেনার উপায় হলো এদের চোঙ্গা বা ফানেলের গায়ে দুটো সাদা রঙের ব্যান্ড ছিলো।

অন্য কম্পানিটির নাম ছিলো ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশান সংক্ষেপে আই, জি, এন। এদের ফানালের রঙ ছিলো কালো। এদের জাহাজের নাম ছিলো সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ।

দুই কোম্পানীর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিলো। তবে আমার কাছে আই, জি, এন কোম্পানির জাহাজগুলো ভাল লাগতো। তখন এই জাহাজগুলো ছিলো বাষ্পচালিত। এই জন্য এগুলোকে ষ্টীমার বলা হতো। কয়লা জ্বালিয়ে বয়লারে বাষ্প তৈরি করে ইঞ্জিন চলতো।

জাহাজের উপরের ডেক থেকে ইঞ্জিনরুম দেখা যেতো। হুস হুস করে বাষ্পের চাপে পিস্টন গুলো ওঠানামা করত। ঐ বয়সে দেখতে বেশ ভয় লাগতো। সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম জাহাজের নিচতলায় জাহাজের দিক পরিবর্তনের জন্য যে হাল যাকে সন্দ্বীপের লোকেরা সুকান বলতো, সেটা ঘোরাবার জন্য একটা ছোটো বাস্পীয় ইঞ্জিন ছিলো। উপরের ব্রিজ থেকে সুকানী চাকা ঘোরালে ইঞ্জিনটা বিকট শব্দ করে হাল ঘুরাবার চেইনকে এদিক ওদিক টেনে হাল ঘোরাতো।

এই যুগে একটা সুইচ টিপে বিশাল জাহাজ ঘুরানো হয়। তবে ঢাকা থেকে রকেট সার্ভিসে যেসব জাহাজ চলত সেগুলোর মতো এগুলো প্যাডেল ষ্টীমার ছিল না। এদের প্রপেলার ছিল আধুনিক জাহাজের মতো পেছষের দিকে ।

চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে ভোর বেলায় ষ্টীমার ছাড়লেও আগের রাতে সবাইকে জাহাজে উঠে যেতে হতো। আমার বাবা আমাদের জন্য একটা প্রথম শ্রেণির কেবিন বুক করতেন। বেশ বিলাসবহুল ছিলো এগুলো। জাহাজের সামনে ভাগে ছিলো বিশাল ডেক। সেখানে আরাম কেদারা ছিলো বসার জন্য। রাতে আমরা জাহাজে ঘুমিয়ে পড়তাম।

সকালে জাহাজের ভেঁপু শুনে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। কেবিন থেকে বাইরের ব্যালকনীতে আসলে দেখা যেতো জাহাজ কর্ণফুলীর ছোটো ছোটো ঢেউ ভেঙ্গে চলছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। নদীর একপাশে ছিলো চট্টগ্রাম বন্দর। বিচিত্রসব বিদেশী জাহাজ ভিড়ে থাকতো। দূর থেকে জাহাজের নাবিকগুলোকে দেখতে বামুনের মতো মনে হতো।

এরপর আসতো নৌবাহিনীর ঘাটী। ছাই রঙের যুদ্ধ জাহাজগুলো বাঁধা থাকত নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে। তবে সেকালে এত জাহাজ ছিলো না। বেশিরভাগ জাহাজ থাকতো করাচীতে। কিছুক্ষণের মধ্যে জাহাজ মেরিন একাডেমীর কাছে চলে আসতো। এখানে কর্ণফুলী নদীতে একটা বড় বাঁক আছে। বাঁকের ডানদিকে তাকালে দেখা যেতো পতেঙ্গা বিমানঘাঁটি। তখন এটা বিমান বন্দর হয়নি। এটি তৈরি করা হয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। দূর থেকে একটা হলুদ রঙের হ্যাঙ্গার দেখা যেতো। ১৯৬০ সনের সাইক্লোনে এই হ্যাঙ্গারটা ভেঙ্গে তসনস হয়ে যায়।

এরপর ডানদিকে বাতিঘরটা পার হলেই জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতো। শুরু হয় ভ্রমনের নতুন অধ্যায়। জাহাজ তখন বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মুখে পড়ে যেতো। একটু বাতাস থাকলেতো কথাই নেই। ঢেউয়ের সাথে সাথে ওঠানামা করত জাহাজ। এটাকে বলা হতো রোলিং। সন্দ্বীপের লোকেরা বলতো দেওয়ানী। দু'একটা ঢেউ আছড়ে কেবিনে ঢুকে যেতো। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার ছিল জাহাজের দুলুনিতে মাথা ঘুরাতো আর বমি হতো বড়োরা বলতেন দূরে দিগন্তের দিকে তাকাতে, তাতে না কি মাথা ঘুরানো কমে যায়। কিন্তু সাগর ঠান্ডা থাকলে বেশ মজা।

জাহাজের আশে পাশে গাংচিলের কিচির মিচির, পাশ দিয়ে যাওয়া পালের নৌকার মাঝিদের হাতনাড়া, মাঝ সাগরে জেলেদের জাল ফেলার দৃশ্য খুবই উপভোগ্য। সাগরের এক যায়গায় আসলে দেখা যায় পানিতে দুটো স্রোত। এখানে ফেনী নদীর পানি সন্দ্বীপ চ্যানেল ধরে বঙ্গোপসাগরে মেশে। একটা স্রোতের পানি ঘন সবুজ আর একটা কাদাযুক্ত ময়লা পানি। মনে হয় কে যেন মাঝখানে একটা দেওয়াল দিয়ে রেখেছে।

বঙ্গোপসাগরে আনুমানিক দুই ঘন্টা চলার পর দূরে সন্দ্বীপের ক্ষীণ রেখা দেখা যায়। জাহাজ যতই এগোয় রেখাটা আস্তে আস্তে উঁচু হতে থাকে। এগুলো সন্দ্বীপের উপকূলের গাছপালা। মন উত্তেজনায় ভরে ওঠে কখন জাহাজ সন্দ্বীপে ভিড়বে? এর পর প্রায় ঘন্টা খানেক জাহাজ সন্দ্বীপের কূল ঘেঁসে চলে। এক পর্যায়ে জাহাজের ভেঁপু তিনবার বেজে ওঠে। বোঝা যায় জাহাজ ঘাটের কাছে এসে গেছে। ভেঁপু তিনটা কিনারে থাকা নৌকাগুলোকে জাহাজের দিকে আসার আহবান।

সন্দ্বীপে কোনো জেটি তখনো ছিলো না এখনও নেই। নদী ভাঙ্গনের জন্য জেটি বানানো যায় না। তাই স্থানীয় নৌকায় করে যাত্রীদেরকে জাহাজ থেকে নামিয়ে কিনারে নেওয়া হয়। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। যারা প্রথম সন্দ্বীপ গিয়েছেন তাদের জন্য এটা সত্যি আতঙ্কজনক।

নৌকাগুলো জাহাজের গা ঘেঁসে ভিড়লেই যাত্রীদেরকে রীতিমত ধাক্কা দিয়ে জাহাজ থেকে নৌকায় নামানো হয়। যদি ঢেউ বেশি থাকে তখন ঢেউয়ের তালে নৌকা যখন উপরে ওঠে তখন যাত্রীদেরকে লাফ দিয়ে জাহাজ থেকে নৌকায় উঠতে হয়। নৌকা ভরে গেলে দাঁড় বেয়ে নেয়েরা সন্দ্বীপের কূলে নিয়ে যায়। এত কষ্টের পরেও মাতৃভূমির আকর্ষণে সন্দ্বীপবাসিরা স্টীমারে পাড়ি দেয় সন্দ্বীপের উদ্দেশে।