আজ মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪ || ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার, ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন
সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪   |   sonalisandwip.com
নববর্ষের সাতকাহন :: কাজী মিনহাজ উদ্দীন রুদবী

বাংলা ১৪৩০ সাল বিদায় নিচ্ছে, আসছে নতুন বর্ষ ১৪৩১ সাল। নতুন বর্ষকে বরণ করে নিতে আনন্দে মেতে উঠছে বাঙালী। পহেলা বৈশাখের এ আনন্দ উৎসব চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালী এ উৎসবে অংশগ্রহন করে বিধায় বর্ষবরণকেই স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র সার্বজনীন জাতীয় উৎসব বলা যায়।

আমাদের মুসলিম সমাজের অনেকের ধারণা নববর্ষের উদযাপন একটি হিন্দুয়ানি প্রথা। আমি এ মতের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান ব্যাখা করার চেষ্টা করছি এবং বঙ্গ, বাঙ্গালী ও বঙ্গ ভাষার উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়েই লেখাটির সূচনা করছি।
বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ঠিক কখন থেকে বাঙালী জাতি বঙ্গদেশে বসবাস করা শুরু করেছে তার সঠিক কোন তথ্য ইতিহাসবিদদের হাতে নেই। তবে কিছু প্রত্মতাত্বিক আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় আমাদের পূর্ব পুরুষরা নব্য-প্রস্তর যুগে ও তাম্র যুগে এ অঞ্চলে বসবাস করত।

প্রাচীনকালে সমগ্র বাংলা কোন নির্দিষ্ট নামে পরিচিত ছিল না। পুন্ড্র (বরেন্দ্র ও রাঢ়), সুক্ষ (তাম্রলিপি ও সমতট) ও বঙ্গ (বঙ্গাল ও হরিকেল) এই প্রধান তিনটি নামে বাংলা পরিচিত ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এ অঞ্চলগুলো বিভিন্ন রাজা দ্বারা বিচ্ছিন্নভাবে শাসিত হতো।

“বং” এবং “আল” শব্দের সমম্বয়ে বঙ্গাল এবং পরবর্তীতে বাঙাল বা বাঙালী শব্দের উদ্ভব হয় বলে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন। “বং” শব্দটি প্রাচীন অস্ত্রিকদের সমগোত্রীয় মুন্ডাদের ব্যবহৃত ভোটচীনীয় ভাষার শব্দ যার অর্থ জলাভূমি বা নিম্মভূমি এবং আল অর্থ পার্থক্য বা আলাদা করা এটি আরবী শব্দোতভূত।

প্রাচীন বাংলার মানুষ নীচু জলা ভূমিতে আল দিয়ে জমি ঘেরাও করে কৃষিকাজ করতো বলে সম্ভবত তাদের এই নাম হয়েছে। সম্রাট আকবর আমলে সমগ্র বঙ্গদেশ সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম শাসন আমলের প্রথম দিকে দেশ বাচক নাম হিসাবে সর্বপ্রথম “বাংলা” শব্দের ব্যবহার শুরু হয়।

মুসলিম প্রশাসনে ফারসিতে বাংলাকে “বঙালাহ” লিখা হতো এবং বঙালাহ শব্দটিকে ইংরেজরা "Bengal"; বানানে লিখত।

বাংলাদেশের সর্ব প্রাচীন অধিবাসী ছিল কৃঞ্চ বর্ণের ও খর্বাকৃতি আদি অস্ত্রাল জাতি। অস্ত্রালদের সাথে সর্বপ্রথম দ্রাবিড়-ভাষী ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রন ঘটে যারা ছিল দীর্ঘদেহী ও পীত বর্ণের। এরপর ক্রমাম্বয়ে গোল মাথার আর্যভাষী আলপিয় এবং লম্বা মাথার বৈদিক আর্যভাষীদের সংমিশ্রনে বাঙালী
জাতির উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে তুর্কি, পাঠান, মুঘল, ফারসী, আরবী, ওলন্দাজ ও যৎসামান্য ইংরেজ রক্তের সংমিশ্রনও ঘটেছে বিধায় পৃথিবীতে বাঙালী জাতির মত বহু মিশ্রিত শংকর জাতির উদাহরণ খুব কমই আছে।

তবে বাঙালী মূলত অনার্য-বংশ উদ্ভূত এবং এ অঞ্চলের সর্ব প্রাচীন অধিবাসীর উত্তরসূরী যারা মোটামুটি সভ্য ছিল এবং যাদের আবিমিশ্র বংশধর বর্তমানের অধিবাসী সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা ইত্যাদি।

‘বাংলার সর্বপ্রাচীন ভাষা ছিল আস্ত্রালদের অস্ট্রিক ভাষা, অস্ট্রিক ভাষার সাথে দ্রাবিড় ভাষা ও ভোটচীনীয় ভাষার মিশ্রন ঘটে যে রুপ ধারন করে তা পরবর্তীতে ভারতীয় আর্য ভাষার শক্ত প্রভাব বলয়ে থেকে বর্তমান বাংলা ভাষার আদিরুপ পরিগ্রহ করে।

এই আদি রুপটি ক্রমবিবর্তিত হয়ে সংস্কৃত, প্রাচ্য, পূর্বমাগধী, বঙ্গ-অসমিয়া, প্রভৃতি স্তর পেরিয়ে বর্তমান বাংলা ভাষা হিসাবে আতœপ্রকাশ করে। বাংলা ভাষাকে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা বলা হলেও ভারতীয় আর্য ভাষার সঙ্গে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটবর্মী এবং আলপিয়দের আর্য ভাষার সংশ্লেষনের ফলেই এই ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
বাঙালীর ধর্ম নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে আদি বাঙালিরা ছিল মূলত জড়বাদী ও প্রকৃতি পূজারী। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক বুদ্ধদেব ও জৈন ধর্মের মহাবীর এদেশে ধর্ম প্রচার করার জন্য এসেছিলেন বলে জানা যায়। বাঙালীদের এটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ও কিছু জনগন জৈন ধর্ম গ্রহন করে।

পরবর্তীতে বঙ্গদেশে বৈদিক আর্যদের আগমন ঘটে যারা ছিল ব্রাহ্মন্যবাদী। এদের দীর্ঘস্থায়ী শাসন ও শোষনে বাঙালীর ধর্ম বিশ্বাস এদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। বৈদিক আর্যরা বাঙালী বৌদ্ধদের চরমভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন করে এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারকে স্তদ্ধ করে দেয়। আর্যরা তাদের ধর্মের অনুসরণ করার পরও বাঙ্গালীদের আপন করে নেয়নি বরং তাদের নীচু, অস্পৃশ্য, অসুর,
স্লেচ্ছ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে তাদের পদদলিত করে রাখে। বেদ পাঠ বাঙ্গালীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল এবং আর্য ব্রাহ্মণরাই বাঙ্গালীদের সাক্ষাত দেবতা হয়ে জোরপূর্বক নিজেদের পূজনীয় করে তোলে।
লক্ষণ সেনের পূর্বে কিংবা

সমসাময়িককালে এদেশের মুসলিম ধর্মপ্রচারক তথা আউলিয়া, সূফি দরবেশের আগমন ঘটতে থাকে। ইখতিয়ার উদ্দীনের নিকট লক্ষণ সেনর পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। অল্প সময়ের মধ্যে মুসলমানদের নিকট আর্য হিন্দু রাজরা ক্রমাম্বয়ে পরাজয় বরণ করতে থাকে।
মুসলমান দরবেশদের ধর্মপ্রচার ও আধ্যান্তিকতায় ব্রাহ্মণ্য শোষণে নির্যাতিত বাঙালী তথা নিম্মবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। অনেক বাঙ্গালী বৌদ্ধও ইসলামের সাম্যবাদে আকৃষ্ট হয়ে মুসলিম হয়েছিল। উচ্চ বর্ণের কিছু আর্য হিন্দুও মুসিলম শাসকদের নেক নজরে এসে রাজকীয় দায়িত্ব পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। ধীরে ধীরে বাংলার অর্ধেকের বেশী লোক মুসলমান হয়ে যায়।
বাঙালীদের স্ব-শাসন বা স্বাধীনতার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আদি যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে স্ব-শাসিত ছিল। বৃহত্তর পরিসরে একমাত্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাঙালী “পাল রাজ বংশ” স্বাধীনভাবে বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল।

কৈবর্ত্য বিদ্রোহের সময় মদন পালের স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে প্রসাদ বিপ্লব ঘটিয়ে ব্রাহ্মন্যবাদী অবাঙ্গালী বিজয় সেন সেন রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। আবার ১৪১৪ থেকে ১৪৩৬ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা যথাক্রমে গনেশ, জালাল উদ্দিন ওরফে যদু ও শামছুদ্দিন আহমদ শাহ এই তিনজন দ্বারা শাসিত হয় আর এই শাসকত্রয় ছিলেন বাংলাভাষী বাঙ্গালী। তাই ঐতিহাসিকগণ এই সময়টিতে বাঙ্গালী কারো অধীনে ছিল না বলতে চান।
বিদেশী তুর্কী মোগল আর পাঠানরা এদেশের মাটি আর মানুষের সাথে মিশে গিয়ে বাঙালীদের হৃদয় জয় করার এবং বিদেশী মুসলিম অলী দরবেশদের আধ্যান্তিক সংস্পর্শে মুগ্ধ হয়ে প্রচুর বাঙালী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। এসব বাঙালীরা বিদেশী মুসলিমদের দ্বারা শাসিত হয়েও নিজেদের স্বাধীন ভাবতে থাকেন।

১৭৫৭ সালে মীর জাফর আলী খাঁন, জগৎ শেঠ উমী, রায় বল্লভ প্রমূখ প্রশাসনিক দায়িত্বেরত হিন্দু-মুসলিম কর্মকর্তার বিশ্বাস ঘাতকতার কারনে দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মন বংশজাত বাংলার স্বাধীন নবাবতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকূলী খাঁর উত্তরসূরী বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের নিকট পরাজয় বরণ করতে হয় এবং বাঙালী প্রায় ২০০ বছর ভিন দেশী খ্রীস্টান ইংরেজদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ তথা ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতার দ্বারা হতভাগ্য বাঙালীর প্রভুর পরিবর্তন হয়; সত্যিকারের অর্থে স্বাধীনতা তারা পায়নি।
১৯৭১ এ সহ¯্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বাঙালীরা স্বাধীনতা অর্জন করে এবং হাজার বছর পর এ অঞ্চলে আবার বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে।

বর্তমানে বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ জনগন বাঙালী মুসলমান বাকীরা হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। উপরের আলোচনা দ্বারা আমরা এতটুকু বুঝতে পারছি বঙ্গভূমির মিশ্রিত বঙ্গভাষী শংকর প্রজাতীর বাঙ্গালীরা আদি থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ কোন ধর্ম দ্বারা সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল না।
এখন আমি নববর্ষ বিষয়ক মূল আলোচনায় ফিরে আসব। পূর্বে বঙ্গদেশে হর্ষাব্দ, গুপ্তাব্দ, শকাব্দ, লক্ষন সন, বিক্রম সন, শালিবাহন সন, জালালি সন, সেকান্দার সন ইত্যাদি বিভিন্ন রকম বর্ষ গণনা চালু ছিল। এসব সনের অধিকাংশই চন্দ্ররীতি অনুসারে গণনা করা হতো। সৌর বর্ষের সাথে এর গরমিল দেখা দিত প্রায়ই। ফলে প্রতি তিন বছরে চন্দ্রবর্ষে এক মাস অতিরিক্ত যোগ করে সৌরবর্ষের সাথে মিলিয়ে নেয়া হতো।

এ ধরণের গোজামিলে বর্ষ গণনায় সাধারণ মানুষের খুবই অসুবিধে হতো। শাসক শ্রেণীরও নির্দিষ্ট দিনে
খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। এসব কারনে গ্রাম বাংলার কৃষি নির্ভর বাঙালীর নিকট এসব বর্ষ গণনা স্থায়ী হয়নি। স¤্রাট জালাল উদ্দিন আকবরের নির্দেশে মহাপন্ডিত ফতেহ উল্লাহ সিরাজী ১৫৮৪খৃস্টোব্দে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছরকে অর্থ্যাৎ ৯৬৩ হিজরীকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন।

সিরাজী সাহেব সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে হিজরী সনকে ভিত্তি করে সৌর মাসের ভিত্তিতে বঙাব্দের প্রচলন করলেও পূর্বে প্রচলিত শকাব্দ থেকে মাসের নামগুলো নিয়েছিলেন। এভাবে সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করে কৃষিজীবি বাঙালী প্রজাদের ফসল তোলার সময়ের সাথে খাজনা গ্রহনের সমম্বয় সাধন করেন যা বাঙালী কৃষক সমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

আকবরের এই ফসলী সৌরসন কৃষিনির্ভর বাংলায় সর্বজন গ্রাহ্যতা পেয়ে সময়ের ব্যবধানে হয়ে গেছে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা আর বাঙ্গালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে বাংলা নববর্ষ আজ বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব।
বর্ষবরণ কেন্দ্রিক আনন্দ উৎসবের প্রচলন পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মাঝে রয়েছে। যেমন ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান, মার্কিনীদের রয়েছে, “নিউ ইয়ার্স ডে”, ইরানী-ফার্সীদের ‘নওরোজ’, চীনাদের ‘চু-জী বা স্প্রীং পেস্টিভ্যাল’, জাপানীদের ‘হাসুমৌদি’, বার্মার ‘থিনগিয়ান’ ইত্যাদি।

উপরে আলাচিত জাতি সমূহের মাঝে নববর্ষ উদ্ধসঢ়;যাপন নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই। প্রত্যেক জাতি এই দিন নিজের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের আলোকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজস্ব সংস্কৃতি ও জাতি সত্ত্বার একাতœতা ঘোষণা করে এবং অমলিন আনন্দে বিলীন হওয়ার প্রয়াস পায়।

কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পর তিনটি যুগ পার হওয়ার পরও আমরা বঙ্গ মায়ের সন্তানেরা নববর্ষ উদযাপন নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত। নববর্ষের উদ্ধসঢ়;যাপনকে অনেকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে এর বিরোধিতা করছেন। তবে এ প্রচেষ্টা নতুন নয়।
ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৪৭সালে যে পাকিস্তানীরা এ দেশের শাসন ভার গ্রহন করেছিল তারা বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষা, বাংলা নববর্ষ, বাঙালিয়ানা ইত্যাদি আমাদের জাতিগত ব্যাপারগুলোকে হিন্দু কালচার বলে নাজায়েজ বলে আমাদের জাতিসত্তাকে দূর্বল করতে চেয়েছিল। তারা বাংলা বর্ণমালাকে বিলুপ্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল; আরবী উদ্ভূত উর্দূ বর্ণমালা দিয়ে বাংলা লেখার প্রচলন করতে চেয়েছিল।

জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ লোকের মাতৃভাষাকে উর্দূর পার্শ্বে স্থান দিতেও রাজি হননি। এরই প্রেক্ষিতে আসে রক্তের অক্ষরে লিখা ৫২’র ভাষা দিবস ৮ই ফাল্গুণ যা আজ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ শে ফেব্রুয়ারী। আসে ৭১ আমাদের
স্বাধীনতা, বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠতম অহংকার।
আমরা নৃতাতিœক দিক থেকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের আদি নিবাসী বাঙালী জাতি, আমাদের মাতৃভূমি পূর্ব বাংলা, মাতৃভাষা বাংলা ভাষা, আমাদের রাষ্ট্রের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় বাংলাদেশী এবং ধর্মীয় পরিচয়ে আমরা ৯০% মুসলমান, ৯% হিন্দু ও ১% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।

সুতরাং বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ মুসলিম জনসাধারণ বাঙালী জাতীয়তাবাদের ও বাংলাদেশী নাগরিকত্বের অধিকারী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক যাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং এ বিষয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। একই উৎস থেকে উদ্ভূত এ ধরনের মৌলিক
পরিচিতি বিশিষ্ট জাতি পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
একইভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্ধসঢ়;যাপন বাঙালী জাতির মৌলিক ও সার্বজনীন উৎসব, একে হিন্দুয়ানি প্রথা হিসেবে অভিহিত করা নিজেদের জাতি সত্ত্বাকে সংকীর্ণ করারই নামান্তর এবং অযৌক্তিক।
বর্তমানে বাংলা সন যাদের মাঝে ক্রিয়াশীল ও যাদের দ্বারা উদযাপিত তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান। সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি ৫লক্ষ এবং পশ্চিম বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩১লক্ষ। দুই বাংলার মুসলিম বাঙ্গালীর
সর্বমোট সংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬লক্ষ। অপরদিকে দুই বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি। দুই বাংলার অন্যান্য ধর্মের বাঙ্গালীর সংখ্যা প্রায় ৩৭লক্ষ।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় নিজস্ব ঐতিহ্য হিসেবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছে সমগ্র বাংলার ১৬ কোটি মুসলিম বাঙ্গালী, ৩৭ লক্ষ অহিন্দু বাঙালী এবং ৮ কোটি হিন্দু বাঙালী। বাংলা নববর্ষ পালনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেখানে মুসলমানদের সেখানে কোনভাবেই এ উৎসবটি এককভাবে হিন্দুয়ানি প্রথা বা হিন্দুদের উৎসব বলা যায়না।
ভারতের ৯২ কোটি হিন্দুর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র ৬ কোটি বাঙালী বাদ দিলে বাকি ৮৬ কোটি হিন্দু যে নববর্ষ পালন করে তা বাংলা নববর্ষ নয়। বরং তাদের ভিন্ন ভিন্ন নৃতাত্মিক জাতিসত্ত্বা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকারের- যেমন আসামের হিন্দুরা পালন করে “বোহা বিহু” মালয়লি” দিনপঞ্জির প্রথম মাস
মেছমের প্রথম দিনটি পালিত হয় “ভিশু” নামে, মহারাষ্ট্রীয়দের নববর্ষের নাম “গুড়ি পাড়ওয়া”, গুজরাটিদের নববর্ষ “বেস্ববরষ”।

সুতরাং কোনভাবেই ১৬ কোটি বাঙ্গালী মুসলমানের উৎসব “বাংলা বর্ষবরণ”কে যারা হিন্দুদের সংস্কৃতি হিসাবে আখ্যায়িত করতে চাচ্ছে তারা কূপমন্ডুক ছাড়া আর
কিছুই নয়।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা এখানে আলোচনার প্রয়োজন তা হলো বাংলা নববর্ষ আমরা কিভাবে উদযাপন করছি তা খতিয়ে দেখা। কোন কোন হিন্দু ঐতিহাসিক রাজা শশাংককে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলতে চাইলেও ইতিহাস পর্যালোচনায় তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কোন হিন্দু নরপতি নয় মুসলিম শাসক আকবরের নির্দেশে মুসলিম পন্ডিত সিরাজী মুসলিম হিজরী সনকে ভিত্তি করে যে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন তার প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ পালনে ধর্ম বর্ণ গোত্র সব কিছু ছাপিয়ে বাঙ্গালিয়ানার প্রকাশই প্রাধান্য পায়। আদি থেকে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে আনন্দ উৎসবের সাথে কয়েকটি মৌলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে। বিষয়গুলো হচ্ছে খাজনা/ রাজস্ব তোলার অনুষ্ঠান বা পুণ্যাহ; ব্যবসায়ীদের হাল খাতা অনুষ্ঠান, আপামর বাঙ্গালীর বার্ষিক বিকিকিনির মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

রাজা বা জমিদারগণ তাদের প্রজাদের নিকট থেকে বাৎসরিক খাজনা / রাজস্ব আদায়ের জন্য পহেলা বৈশাখকে নির্ধারণ করেন এবং ঐ দিনটিকে তারা বিশেষ জাঁকজমকের সাথে পূণ্যাহ উৎসব হিসেবে পালন করতেন। এ ব্যাপারটি ধর্ম সম্পর্কিত নয় বরং অর্থনীতির সাথে জড়িত। জমিদারী প্রথা বিলোপের সাথে সাথে বাঙ্গালী সমাজ থেকে পূণ্যার বিলুপ্তি ঘটেছে। (বর্তমানে শুধুমাত্র বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু আদিবাসীদের মাঝে পুণ্যাহ উৎসবটি প্রচলিত আছে।)

এরপর আসে হালখাতার ব্যাপার। হালখাতা শব্দটির হাল শব্দটি আরবী যার অর্থ অবস্থা বা দশা আর খাতা শব্দটি ফারসী যার অর্থ একত্রে বাঁধা পত্রাদি বা হিসাবের বহি। হালখাতা শব্দটি মুসলিমদের ধর্মীয়ভাষা থেকে উদ্ভূত।   

নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী হালখাতা অনুষ্ঠান হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ সুন্দরভাবে সজ্জিত করে ক্রেতা গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করায়, পুরাতন বছরের হিসাব সমাপ্ত করে নতুন বছরের হিসাব উন্মোচন করার নিমিত্তে নতুন হিসাবের খাতা তথা হালখাতার উদ্বোধন করেন। এ হালখাতা অনুষ্ঠানের সাথে হিন্দুয়ানি কোন প্রথার লেশমাত্র সংশ্রব আছে বলে মনে হয় না।

নববর্ষে বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে বৈশাখী মেলা বসে তা বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের এক অনবদ্য প্রদর্শনী বা সমাহার। বাঙালী সেদিন মেতে উঠে বিবিকিনির মেলায় যেখানে ক্রয় বিক্রয় হয় হস্ত নির্মিত নানাবিধ মৃৎ শিল্পের তৈজষপত্র ও আটপৌড়ে বাঙ্গালীদের নানাবিধ ব্যবহার্য্য দ্রবাদি। বাঙালী সারা বছর অপেক্ষায় থাকে, কবে আসবে বৈশাখী মেলা, কবে কিনতে পারবে শীতল পাটি,
নতশী কাঁথা, বাঁশের বাঁশী, কাঠের খেলনা, হাতপাখা। আপামর বাঙালীর এই আড়ং যে কোন সম্প্রদায়ের রীতিনীতি থেকে মুক্ত।
নববর্ষে বাঙালীরা পান্তা ইলিশ খায়, পিঠাপুলির স্বাদ নেয়, ঘরে ঘরে রান্না হয় বারো রকম সবজির মিশ্রণে উপাদেয় পাঁচন। আর এসবই চিরায়ত বাঙালীর ঐতিহ্যের অংগ, বাঙালীর এই খাদ্যাভাসের সাথে ইসলাম ধর্মের কোন বিরোধ নাই। নববর্ষে বাঙালী যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাতেও বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাত্ত অনুপস্থিত। বাংলার লালন, হাছন রাজা, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীম উদ্দীন, সুকান্ত, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদ, গুন সবার সব বাঙালীর। এদের সৃষ্ট সাহিত্য, সংগীত,

কাব্য সকল বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বাংলার অমূল্য সম্পদ। তেমনি জারি, সারী, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, বাউল আমাদের মাটি আর মানুষের গান আমাদের সাংস্কৃতিক রতœ। পহেলা বৈশাখে মূলত বাংলার ঐতিহাসিক সংস্কৃতির চর্চাই হয়, অন্য কিছু নয়। সুতরাং এ বিষয়ে আমরা একমত হতে
পারি বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালীর বিশেষ করে বাঙালী মুসলমানদের জাতীয় সত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য অংগ এবং অন্যতম সার্বজনীন উৎসব।
তবে ইদানীং নববর্ষ পালনে এক ধরণের লোক দেখানো আদিখ্যেতা, বেহায়াপনা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি অনুকরণের ব্যাপার পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশাল পশুপাখির মূর্তি ও বিকৃত চেহারার মুখোশ বহন এবং রুচিহীন পোষাকে তরুণ তরুণীর অবাধ মেলামেশা কোন সংস্কৃতির ধারক তা বোধগম্য হচ্ছেনা।

এখানে প্রচ্ছন্নভাবে স্বল্পবসনা চীনাদের ড্রাগনমূর্তি বহন বিশিষ্ট স্প্রীং ফেস্টিভ্যাল তথা “চু-জী”র ও জাপানিদের “হাটসুমৌদির” অনুকরণ দেখা যাচ্ছে। নববর্ষে তরুণেরা ইউরোপিয়ানদের অনুকরণ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে রঙের ছোপ দিচ্ছে বা উল্কি আঁকছে। ইউরোপীয়দের ঢংয়ে জিন্স আর টি-শার্ট পরে বুকে রবীন্দ্রনাথের ছবি এঁকে দিলেই সেটা কখনো বাঙ্গালী ঘরানার পোশাক হতে পারেনা।

ঐতিহ্যবাহী রমনার বটমূলের পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাথে গত ৮০ সাল থেকে প্রবর্তিত মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ করলেও এটিও বিজাতীয় সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন।

নববর্ষে একজন মুসলিম বাঙালীর ধুতি পরে মাথায় টিকলি, কপালে তিলক কেটে সংস্কৃতি ভাষার হিন্দু শাস্ত্রীয় সংগীত গাইতে গাইতে কাছিমের মাংস ভক্ষণ যেমন বর্জনীয় তেমনি কোন হিন্দু বা বুদ্ধের টুপি জুব্বা পরে গোমাংস খাওয়াও গ্রহনীয় নয়।

নববর্ষের উৎসবে কোন সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় রীতিনীতির অনুকরণ ও প্রচলন অবশ্যই পরিত্যাজ্য কারণ এটি নববর্ষের নির্ভেজাল ও নিষ্পাপ আনন্দ উৎসবকে বিতর্কিত করে তুলবে; জানিনা এ ব্যাপারে বোদ্ধাদের কি মতামত।

আমাদের বাঙালী মুসলমানদের একটি ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে যে, আমাদের বর্ষবরণ যেন খ্রীষ্টানদের থার্টিফাস্ট নাইট এর উদযাপনের মত বীভৎস ও নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত না হয়। আমরা বিশ্বাসী জাতি, বিশ্বাস করি পৃথিবীতে যা কিছুই করিনা কেন একদিন মৃত্যুর হিমশীতল বাহনে পরজগতে যেতেই হবে, বিচার দিনে সকল হিসেব নিয়ে স্রষ্টার সম্মুখে আমাদের দাঁড়াতেই হবে।

তাই খেয়াল রাখতে হবে নশ্বর এ পৃথিবীর কোন সীমালঙ্ঘন যেন পরজন্মের অনন্ত সুন্দর অবিনশ্বর জগতকে বিনষ্ট না করে। সকল বাঙালীকে সুন্দর সাবলীল রুচিশীল অসাম্প্রদায়িক নববর্ষের সালাম ও শুভেচ্ছা।


লেখক পরিচিতি :: সম্পাদক ও প্রকাশক- মাসিক সোনালী সন্দ্বীপ, সিনিয়র সহ সভাপতি- চট্টগ্রাম অনলাইন প্রেসক্লাব, উপদেস্টা- মসজিদ ডট লাইফ